লেখকঃ সত্য বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা
স্বজাতির অতীত সম্পর্কে জানার সাধারণ ও স্বাভাবিক আগ্রহের কারণে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি সম্পর্কে কিছু লেখা পড়েছি। এ থেকে আমার মনে হয়েছে আমাদের অতীত ইতিহাসের উপর ধারণা অপেক্ষাকৃত বেশী যুক্তিনির্ভর হওয়া প্রয়োজন । একই সাথে বর্তমানে আর্থ – সামাজিক অবস্থান ও সংস্কৃতির ধরণ থেকে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ গতিমুখ সম্পর্কে একটা আভাস / সম্ভাবনা অনুমান করাও আবশ্যক ।
“বার্মা ও ভারতে তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থান এবং তাদের অন্যান্য বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান শিরোনামে একটি প্রবন্ধে (ন – আ শমন , ৩য় সংখ্যা , ৩য় বর্ষ , ২০০৬ ইং ) এ সি তঞ্চঙ্গ্যা পরিসংখ্যান সহ উল্লেখ করেছিলেন যে , “তঞ্চঙ্গ্যাদের ৭ টি গছার লোকজন দাইনাক নামে বার্মায় বসবাস করছে । “তঞ্চঙ্গ্যাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে স্বনামধন্য লেখক শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ( ১৯৩৪-২০১৪ খ্রীঃ ) একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন- “ আরাকানের দানাওয়াদি তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রাচীন স্বাধীন রাজ্য ” (পহর জাঙাল , ৫ম সংখ্যা, ২০০৯ ইং )। প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি লিখেছেন- “ তঞ্চঙ্গ্যাগণ দাইনাক পরিচয়ে দানাওয়াদি’র (আরাকান) মূল অধিবাসী ছিল ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চাকমা ভাষা, অঞ্জলী ১ম বর্ষ ৫ম সংখ্যা, ১১৫ পৃ: (তৎকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্কুল সমূহের প্রবীণ ডেপুটি ইস্পেক্টর শ্রীযুক্ত গগন চন্দ্র বড়ুয়া কর্তৃক লিখিত বলে অনুমিত) থেকে উদ্ধৃত করে ‘ চাকমা জাতি ‘ গ্রন্থে (১৯০৯ ইং সনে । প্রকাশিত) সতীশ চন্দ্র ঘোষ লিখেছেন- আরাকানের পাহাড়ী জাতির অপর এক সম্প্রদায় তাহাদের সহিত মিশ্রিত হইয়া চাকমার অনুকরনে কথাবার্তা বলিতে শিখিলেও চাকমাগণ তাহাদিগকে আপন সমাজভূক্ত করিয়া লয় নাই , এমন কি বিবাহাদি কার্যে কোনরূপে ইহাদের সহিত সম্বন্ধ হয় নাই । চাকমারা সাধারণত : ইহাদিগকে এতটুকু ঘৃণার চক্ষে দেখিয়া থাকে । “(অনলাইন সংস্করন, পৃ : ৫৩-৫৪ ) । এর পর সতীশ ঘােষের মন্তব্য- “ এংখ্যং ও ইয়ংখ্যংবাসী দৈনাকেরাই আরাকানের পাহাড়ী তঞ্চঙ্গীয়া হইবে । অতএব এখানে আমরা আরও দৃঢ়তার সহিত দৈংনাক ও তঞ্চঙ্গ্যাদিগকে এ অভিন্ন জাতি বলিয়া স্বীকার করিতে পারি । ” একই গ্রন্থের ৫২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন ” দৈনাকেরা যে চাকমাগণেরই অন্যতম শাখা তাহা সর্বদিসম্মত । ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে রাজা জান বক্স খার শাসনকালে দৈকেরা পিতৃকূল পরিত্যাগ করিয়াছে । বিবাহ সম্বন্ধীয় গোলযোগই ইহার কারণ । ” অথচ ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- “ অনেক প্রাচীন চাকমাকেও জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিয়াছি দৈনাক ‘ টিও তাহাদের অত । পরন্তু মঘেরা টংচঙ্গ্যাদিগকেই দৈনাক নামে অভিহিত করিয়াকে । ”
‘চাকমা দুই রাজবংশ ‘ (২০১৪ ইং সনে প্রকাশিত) পুস্তকের পৃঃ – ১০ এ লাইন ১৩- ২০ তে লেখক কুমুদ বিকাশ চাকমা তার আরাকান ভ্রমনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন “যাদুঘর ঘুরতে ঘুরতে আমরা এমন এক জায়গা ও কক্ষে স্বামী – স্ত্রী বা পুরুষ – মহিলার মডেল হিসাবে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় পোষাকে দেয়ালে রাখা হয়েছে ।
১ নং মডেল খুমী জাতি ।
২ নং মডেল ম্রো জাতি ।
৩ নং মডেল রাখাইন জাতি ।
৪ নং মডেল দৈনাক ‘ জাতি । (যেটা আমাদের বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি)
৫ নং মডেল থেক বা সেক জাতি ।
এই থেক বা সেক ‘ জাতির পোশাক অবিকল আমাদের চাকমা মহিলাদের পিনন খাদি । পিননের উপরে চাবুগীটা রয়েছে। ”উপরোক্ত বিভিন্ন সূত্রের আলােকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় তা হচ্ছে- দাইনকি ও তঞ্চঙ্গ্যাদের পূর্বপুরুষ একই গোত্রজাত তথা এক জাতি । তাদের উত্তরসূরী বর্তমান মায়ানমার এর আরাকানে দাইনাক এবং বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গ্যা । তাহলে একই ধারার জনগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয় দুই নামে হলো কিভাবে ? এবং কোনটি আগে, কোনটি’র নামকরণ বা পরে! এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য সতীশ ঘোষের ‘ চাকমা জাতি ’ বই এর ৫৩ পৃষ্ঠা এবং সাংবাদিক জামালউদ্দিন এর লেখা “ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ‘ ( প্রকাশকাল- ২০১১ ইং ) বই এ ( পৃ: – ১১৩ ) উল্লিখিত লাইনগুলাে পড়তে হয় । Captain T H Lewin ( D C of Chittagong Hill tracts in 1866- 69 & 1871- 74 ) লিখিত Hill Tracts of Chittagong and dwellers there in ( 1869 তে প্রকাশিত ) গ্রন্থের বরাত দিয়ে লেখকগণ উল্লেখ করেছেন যে , “ ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে আরাকান থেকে ফা’র নেতৃত্বে প্রায় চার হাজার টুংটইংগা চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে এসেছিল । এই টুইংগারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসের অনুমতি লাভে নিজেদের শ্রম ও অর্থকড়িতে চট্টগ্রাম নগরীতে জব্বার খা প্রতিষ্ঠিত রাজাপুর নামক স্থানে একটি মনােরম বাড়ী নির্মাণ করে দেয় । ধরম বক্স খা ঐ সময় ফাপ্র , কে টুংটইংগাদের প্রধান হিসাবে স্বীকার না করায় তাদের অনেকে তার সাথে অন্যত্র চলে যায় । বর্তমানে ( ১৮৬৯ খ্রীঃ অব্দে এখানে ) ইহাদিগের সংখ্যা ২৫০০। প্রাচীনেরা আরাকানী ভাষায় আলাপাদি করে ; পরবর্তী পুরুষ অন্যদের ( অর্থাৎ চাকমাদিগের ) অনুকরনে বিকৃত বাঙ্গালা ব্যবহার করিয়া থাকে । ” এই টুংটইংগা ‘ নামটির বানান ইংরেজীতে লুইন সাহেব লিখেছিলেন Taungjyny । তার উল্লিখিত টুংটইংগাদের চট্টগ্রাম আগমনের সময় থেকে ৫০ বছর পর জনগোষ্ঠীটার নাম তিনি নিশ্চয়ই সরকারী নথি থেকেই পেয়েছেন অথবা শুনেছেন । আরাকান থেকে আগত উক্ত জনগোষ্ঠী যদি দৈনাক বা দাইনাকদের একটা অংশ হয়ে থাকেন তাহলে তাঁদের নাম কেন ‘ Taungjyny ‘ হল , ‘ চাকমা ‘ হলো না কেন ? ফাপ্রু যদি দলপ্রধান হিসেবে ধরম বক্স খা কর্তৃক স্বীকৃত হতেন তাহলে হয়তো আগত লোকেদের জাতিগত / সম্প্রদায়গত অথবা গছার পরিচিতি ফাপ্রুর নামে হত । তা হয়নি ।
শ্রী যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ( তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি- পৃ : – ৪ ) , শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা ( তঞ্চঙ্গ্যা পরিচয় পৃ: – ৫ ) এবং শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা ( তঞ্চঙ্গ্যা জাতি- পৃ : – ১২ ) প্রমূখ লেখকগণের মতানুসারে- “তৈনছড়ি থেকে আগত বলে তারা তৈ – তং – য়্যা / তৈনতংগ্যা / তংচয়্যা নামে অভিহিত হয়েছেন ।” উল্লেখ্য যে , বর্তমানে বান্দরবান জেলার অন্তর্গত আলীকদম উপজেলায় মাতামুহুরীর একটি উপনদী হচ্ছে তৈনছড়ী। মারমারা নদী বা খালকে দুং বলেন । তৈনছড়ী উপনদীকে মারমারা বলেন তৈনছং । “দৈনাকদের একটা অংশ দীর্ঘদিন ধরে তৈনছড়ি এলাকায় বসবাস করে ছিল ” (Tanchangya- by Rupak Devnath , page- 89 ) । তাই তৈনছড়ী বা তৈনচং থেকে আগত রাজানগরে ধরম বক্স খার নিকট আশ্রয়প্রার্থী জনগোষ্ঠীকে যদি রাজ – কর্মচারী বা কর্মকর্তাগণ Taungjyny বলে রেকর্ডভূক্ত করেন তবে সেটাই স্বাভাবিক । Taungjyny থেকে টংতংয়া ( চাকমারা যে নামে বলেন ) , টংতংয়া থেকে বিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশে আগত দাইনাক জনগোষ্ঠীর একটা অংশের বর্তমান জাতিগত পরিচয় বাংলা বানানে ‘ তঞ্চঙ্গ্যা ’ ( Tanchangya ) নামে অভিহিত হচ্ছে।
দাইনাকদের সম্পর্কে এ.সি তঞ্চঙ্গ্যা তার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন । এ কথা বলা আবশ্যক যে , দাইনাকদের জাতিগত নামকরণের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় তিনি সতীশ চন্দ্র ঘােষের বর্ণিত দেঙ্গাওয়াদি আরেদফুং ( দান্যাওয়াদি আরে তবুং ) এবং আরাকান নিবাসী বােলয়্যা দাইনাকের মত অনুসরণ করেছেন । মনিজগিরি ( মইচাগিরি ) ‘ র কথিত যে রাজা ইয়ংজ আরাকান রাজা মেঙ্গাদি কর্তৃক পরাজিত ও বন্দী হবার ফলে ধৃত তার দশ হাজার প্রজাদেরকে দাইনাক আখ্যা দেয়া হয়েছিল বলে উল্লিখিত হয়েছে- সেটি ইতিহাসের বিচারে প্রশ্নবিদ্ধ । Hisyory of Burma ( 1883 ) গ্রন্থের লেখক Sir Arthur Phayre এর বরাত দিয়ে রাঙ্গামাটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক অশোক কুমার দেওয়ান তার চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার ‘ বই ( প্রকাশকাল -১৯৯১ ইং ) এর ৬১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন , “ ফেইরীর ব্রহ্মইতিহাসে আরাকান রাজ মেংদি কর্তৃক সাক রাজ্য জয়ের কোন বিবরণ নেই বরং Myinsaing এর শান জাতি কর্তৃক উল্টো আক্রমনেরই উল্লেখ আছে । “দেঙ্গ্যাওয়াদিতে যে সময়ে রাজা মেংদি কর্তৃক শাক রাজ্য জয়ের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে ঠিক সে সময়ে Myinsaing এর সান রাজাগণের বংশতালিকায় রাজা U – Za – Na বা Usana- র নাম পাওয়া যায় , যিনি ৬৮৪ মঘাব্দে বা ১৩২২ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন এবং ১৩৪২ খৃষ্টাব্দ অবধি বিশ বৎসর কাল রাজত্ব করেন । দেঙ্গ্যাওয়াদির বর্ণিত বিশ বৎসর কাল রাজত্ব করেন । দেঙ্গ্যাওয়াদির বর্ণিত তারিখ যদি সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয় তবে উপরোক্ত ঘটনা তারই সময়ের ।”
উপরে উদ্ধৃত বক্তব্য সঠিক গণ্য করলে যুদ্ধবন্দী দশহাজার চাকমা থেকে দৈনাক জাতির উৎপত্তি’র যে কাহিনী প্রচলিত তা ‘ বানোয়াট ও মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় ।
এ সি তঞ্চঙ্গ্যা তার পূর্বোক্ত প্রবন্ধে যুক্তি দিয়ে অনুমিত সিদ্ধান্ত টেনেছেন আরাকানের প্রাচীন নগরী ‘দান্যাওয়ার্দীতে যাদের উৎপত্তি বা বিকাশ ঘটেছে তারা দাইনাক নামে অভিহিত হয়েছেন অথবা বলা যেতে পারে দাইনাকদের আবাস অঞ্চল কিংবা তাদের শাসিত অঞ্চলকে দানাওয়াদি নামে অভিহিত করা হয়েছে ‘।
তঞ্চঙ্গ্যা জাতির অতীত ইতিহাস দাইনাক নামের সাথে সম্পর্কিত । একারণে দাইনাক নামের উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণা যথাযথ যুক্তিনির্ভর হওয়া প্রয়োজন । তেমনি দেশান্তরিত হয়ে দাইনাকদের একটা অংশের চট্টগ্রাম আগমন ও জমিদার ধরমবক্স খাঁ’র নিকট আশ্রয়প্রার্থী হবার কারণও স্পষ্ট হওয়া দরকার । এ পর্যন্ত প্রাপ্ত আরাকানের ইতিহাস থেকে এ সম্পর্কে হয়তো কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে ।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়- খ্রীষ্টপূর্ব হাজার বছর আগে থেকে আরাকানের রাধানী হিসেবে ধান্যাওয়াদি ( Dhanyavadi ) নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । শেষ পর্যায়ে ভারতবর্ষ থেকে ইন্দো – আর্য ভাষা ভাষী দ্বন চন্দ্র ( Dvan candra ) নামে একজন পরাক্রমশালী রাজা ১০১ জন রাজাকে পরাভূত করে আরাকানে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাপূর্বক তৃতীয় ধান্যাওয়াদি নগর নির্মাণ করান । উক্ত ধান্যাওয়াদি নগর থেকে তিনি ৩৭০- ৪২৫ খ্রীষ্টাব্দে আরাকানে অধিকৃত অঞ্চলে রাজত্ব করেছিলেন। ( মায়ানমার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আবিষ্কৃত একটি ধান্যাওয়াদি নগর সিত্তোয়ে শহর থেকে ৯৫ কিলোমিটার উত্তরে কলাদান ও লেমরু নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত )। উক্ত রাজার উত্তরসূরীগণ ধান্যাওয়াদি নগরের ৯ কিলোমিটার দক্ষিনে ভেসালি (Vesali / VVetheli) নামে একটি নগর স্থাপন করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। তবে এর পূর্ব থেকে তিব্বেতো – বার্মান ভাষা ভাষী বৈদেশিক শক্তির আক্রমনে চন্দ্রবংশের রাজ – শক্তি দূর্বল হয়ে পড়ে । ৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে আরাকান পাগানের করদ রাজ্যে পরিণত হয় । ১০১৮ খ্রীষ্টাব্দে এ্যা- মিঙ – ঞা তুন ( Nga – Meng nga tun) নামে সাঃ (Sak বা Thek) বংশীয় ( Harvey এর অনুমান) একজন রাজপুত্র ভেসালি ( Vesali / Wetheli ) অধিকার করে ইহার নাম দেন সম্বক ( Sambawak )। পাগানরাজের স্লাইনমা ( বমী ) বাহিনীর সহায়তায় লোমিন – নান (Letyamin – nan) নামে একজন রাজা ১১১৮ খ্রীষ্টাব্দে তার পূর্বসূরীদের সিংহাসনে বসেন এবং আরাকানের রাজধানী পারেইন (Parein) এ সরিয়ে নেন। পরবর্তী সময় পাগানের শক্তি দূর্বল হয়ে পড়লে ১২৩৭ খ্রীষ্টাব্দে লউংগ্রেট (Launggret) এ রাজধানী স্থাপিত হয় । এর কয়েক বছর পর থেকে ১৩৭৪ পর্যন্ত আরাকান রাজারা অনেকটা স্বাধীন থাকে। এ সময়ে আরাকান রাজ্য পশ্চিমে বঙ্গদেশ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে । চতুর্দশ শতাব্দির প্রথম দিকে Myinsaing ও Panya থেকে সান রাজা আরাকান আক্রমন করেছিল বলে Phayre উল্লেখ করেছেন । চতুর্দশ শতাব্দির শেষ দিকে রাজ্যে বেশ কিছু অভ্যুত্থান ঘটে । একের পর এক ক্ষমতার হাত – বদল হয় । অবশেষে ১৪০৪ খ্রীষ্টাব্দে লউংগ্রেট (Launggret) বার্মারাজ মেঙখামং এর দখলে চলে যায় । আরাকানরাজ মিঙ সমউন বঙ্গদেশে পালিয়ে গিয়ে বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ’র দরবারে আশ্রয় নেন । আরাকান উচ্চব্রহ্মে আভার মাইনমা ( বর্মী ) এবং নিম্নব্রহ্মে রাজধানী পেশুর মনদের ক্ষমতার লড়াইয়ের গুটিতে পরিণত হয় । বাংলায় ২৪ বছর আশ্রিত থাকার পর ১৪৩০ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহ’র সেনাবাহিনীর সহায়তায় নিজ রাজ্য ফিরে পেলেন এবং লউংগ্রেট ( Launggret ) থেকে রাজধানী (Mrauk U ) বা ম্রোহং – এ স্থানান্তরিত করেন । পরবর্তীতে বাংলার শাসকগণের দুর্বলতার সুযোগে মিঙসমউন এর পূত্র বা স পু চট্টগ্রাম দখল করেন । উক্ত ক্রমের দ্বাদশতম রাজা মিন বিন ( ১৫৩১- ৫৩খ্রীঃ ) পর্তুগীজদের সহযোগীতায় ঢাকা পর্যন্ত রাজ্য সম্প্রসারণ করেন । মিন বিনের মৃত্যুর পর ( ১৫৫৩ খ্রীঃ) রামু থেকে উত্তরের ভূ – খন্ড আরাকানের হাতছাড়া হয় । আরাকান রাজ মেনখ ফলিঙ ( ১৫৫০-১৫৯৩ ) রামু এবং গােটা চট্টগ্রাম দখলে নেন , তখন থেকে ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইহা আরাকান রাজ্যের অধীনে থাকে। ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দের শুরুতে বাংলার মোগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁর জ্যোষ্ঠপুত্র বুজুর্গ উমেদ যা চট্টগ্রাম দখল করেন । শঙ্খনদীর উত্তর তীর পর্যন্ত চট্টগ্রাম মোগল আমলে মোগল অধিকারভূক্ত থেকে যায়।
উল্লেখ্য যে , অধিকাংশ ইতিহাস গ্রন্থ নির্দিষ্ট কোন স্থান / অঞ্চল / রাজ্য বা দেশের শাসক / রাজা কিংবা কীর্তিমান ব্যক্তিগণের বংশপরিচয় , জীবন বৃত্তান্ত , কীর্তিকলাপ , যুদ্ধ সংঘাত ইত্যাদির বিবরণ নিয়ে লিখিত । সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনধারা , ভাষা , সংস্কৃতি ইত্যাদির উপর আলোকপাত তাতে কমই বিবৃত থাকে । তা সত্ত্বেও বিশেষ বিশেষ সময়ের সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা, সামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাজা – রাজড়াদের অভিযান , যুদ্ধ – বিগ্রহ ইত্যাদির বিবরনের মধ্য থেকে সংশ্লিষ্ট গণমানুষের জীবন প্রবাহ সম্পর্কে রূপরেখা টানা সম্ভব। উপরে বর্ণিত বিবরণ থেকে হয়তাে দাইনাক দের অতীত সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যেতে পারে। উল্লিখিত হাজার / দেড় হাজার আগে ধান্যাওয়াদীর উৎপাদন ব্যবস্থা কিরূপ ছিল?
মধ্যযুগে ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা ও রাজাদের রাজ্য শাসনপ্রণালীর আলোকে অনুমান করা যেতে পারে – ধান্যাওয়ার্দীর রাজপরিবার , রক্ষীদল , রিজার্ভ সেনা , কর্মাধ্যক্ষ , কর্মচারী , দাস – দাসী প্রভৃতি পরিজন পরিবৃত হয়ে রাজা প্রাচীর বেষ্টিত নগরের অভ্যন্তরে থাকতেন , এ ছাড়া অধিকাংশ লোকের বসবাস ছিল নগরের বাইরে । এ ছাড়া ছিল জেলে , তাঁতী , কামার , কুমার , সুতার , প্রভৃতি বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর লােকজন , পরিবার পরিজন নিয়ে তারা নগরের উপকণ্ঠে জনপদগুলোতে থাকতো । নগরের নিকটে কলাদান ও লেমরু নদীর অববাহিকায় সমতল জায়গাগুলোতে ভূমিদাসরা চাষাবাদ করে । নগরবাসীদের জন্য রসদ যোগাতো। আজ্ঞাবহ বিভিন্ন গোত্রের লোকজন পাহাড় এলাকাগুলোতে জুমচাষ , পশুশিকার , পশুপালন , মধু আহরণ ইত্যাদির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। গোত্র প্রধানদের মাধ্যমে রাজা কর আদায় সহ তাদেরকে পরিচালনা করতেন , যুদ্ধের সময় গোত্র প্রধানরা প্রয়োজনে রাজার সেনাদলে লোক যোগান দিত , যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত । যুদ্ধবাজ কোন কোন গোত্রপ্রধান অথবা বিজিত ১০১ জন রাজাদের অনুসারী কেউ কেউ হয়তো মাঝে মধ্যে বিদ্রোহ করতো , রাজ্যে উৎপাত সৃষ্টি করতো। শান্তিপূর্ণভাবে শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে বিভিন্ন দেব – দেবীর মন্দির নির্মাণ করে রাজাগণ ভারতবর্ষ থেকে ব্রাহ্মণ এনে পূজা অর্চনার জন্য তাদেরকে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন , প্যাগোডা , চৈত্য , মন্দির নির্মাণ করে মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছেন ।
৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দের দিকে পাগান থেকে স্রাইনমা ( পরবর্তীতে বর্মী নামে অভিহিত ) বাহিনী কর্তৃক ধান্যাওয়াদী অধিকৃত হবার ফলে তথায় ইন্দো – আর্য সংস্কৃতির প্রভাব ক্রমশ : হ্রাস পেলো , বিপরীতে চীনের ইউনানের নানজাও রাজ্য থেকে আগত স্রাইনমা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলো , নগরের প্রশাসনিক কাঠামো ও সমাজের শ্রেণীবিন্যাস পরিবর্তিত হলো। লেত্ত্যা মিন নান ‘ এর সময় নগরের বাইরে বসবাসরত বিভিন্ন গোত্রের রাজার প্রতি আনুগত্যেরও পরিবর্তন ঘটলো। হত্যা , লুণ্ঠন , যুদ্ধ , সংঘাত প্রভৃতি কারণে এক একটি এলাকা বা অঞ্চল কয়েক বছর অথবা কয়েক দশকের জন্য জনশূন্য হয়ে থাকা , নিরাপত্তা এবং শুধু অর্থনৈতিক ( জুম চাষাদি) কারণেও সমগোত্রীয় বা সমভাষী জনগোষ্ঠীর বাসস্থান পরিবর্তন ছিল স্বাভাবিক ঘটনা । এরূপই যদি হয়ে থাকে তাহলে হয়তো আরাকান রাজের অনুগত কোন গোত্রের আদি বাসভূমি ধান্যাওয়াদি নাম থেকে তাদের পরবর্তী জনগোষ্ঠী দাইনাক নামে অভিহিত হয়েছে । মধ্যযুগীয় গছা ( গোত্র ) ভিত্তিক কাঠামোর উপর দাইনাক এবং তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠির সমাজ গঠিত । উৎপাদন ব্যবস্থা ও সামাজিক কাঠামোর উপর লোকসমাজের জীবনধারা ও সংস্কৃতি আবর্তিত হয় । এই গছা , গুত্তি ( উপ – গোত্র ) ও ডেল (বংশধারা ) ভিত্তিক তঞ্চঙ্গ্যাদের সামাজিক কাঠামো অর্ধ শতাব্দী পূর্বেও যথেষ্ট দৃঢ় অবস্থায় ছিল । তখন একটি পাড়াতে প্রধানতঃ একই গছার লোকজনই বসবাস করত । সামন্তযুগীয় আর্থ – সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সৃষ্ট গোত্র ভিত্তিক সামাজিক কাঠামো তাই হাজার বছর ব্যাপী বিবর্তনের মাধ্যমে এসে দাইনাক / তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে সাম্প্রতিক কালেও বিদ্যমান ছিল । হয়তো ১০১৮ খ্রীষ্টাব্দে চন্দ্রবংশীয় রাজাগণের প্রতিষ্ঠিত সম্বক ( Sambawak ) নগরেও এককালে পূর্বপুরুষগণ বাস করেছিলেন বলে প্রাচীন দাইনকরা কেউ কেউ বলতেন যে , তাদের আদি বাসস্থান সম্বক নগর বা তারা সম্বক নগর থেকে এসেছেন ।
১৪০৪ খ্রীষ্টাব্দে বর্মী বাহিনী কর্তৃক রাজধানী লউংগ্রেট ( Launggret ) দখল হবার পর আরাকান রাজ মিঙসমউন ১৪০৬ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গদেশে গিয়ে আশ্রয় নেয় । তার প্রতি অনুগত বিধায় বর্মী সেনাদের হাত থেকে আত্মরক্ষার্থে নিজ নিজ গোত্র সর্দারদের নেতৃত্বে দাইনকরাও পশ্চিমে আরাকানের শেষপ্রান্তে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষ করে নাফ নদীর পশ্চিমে এবং মাতামুহুরী নদীর উপত্যকার দিকে সরে এসেছিল। সংখ্যাল্পতা কিংবা শক্তি – সামর্থ্যের দূর্বলতার কারণে তখন হয়তো তারা। দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় প্রধানতঃ জুম চাষের উপর নির্ভর করে এ সময় যাযাবরের মত জীবন যাপন করেছিল।
ক্যাপ্টেইন লুইন এর লেখার মাধ্যমে আমরা এখন নিশ্চিত বলতে পারছি যে , ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে Taungjyny রা চট্টগ্রামের পাহাড়গুলিতে এসেছিল এবং তারা জমিদার ধরমবক্স খার অনুমতিক্রমে এখানে বসবাসের সুযোগ পেয়েছিল। তারও অনেক আগে এই জনগোষ্ঠীর পূর্বসূরীগণ অত্র পার্বত্য অঞ্চলে এসেছিল বলে হয়তোনিশ্চিতভাবে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না , কিন্তু অনুমান করা সহজ যে- মিন সমউন এর বঙ্গদেশের রাজধানী গৌড়ে ২৪ বছর অবস্থানের সময় আরাকানে চরম অরাজক অবস্থা বিরাজ করেছিল । গৌড়ের সুলতান জালাল উদ্দিন এর সেনাদের সাহায্যে ১৪৩০ খ্রীষ্টাব্দে মিন সমউন সামন্ত রাজার মত পূন : আরাকানের সিংহাসন লাভ করেন। তখন হয়তো পুর্বোক্ত শরনার্থীদের কিছু অংশ নাফনদীর পূর্বদিকে ফিরে যায় । আবার পরবর্তী আরাকান রাজ মেঙ খ্য রী ( ১৪৩৪- ১৪৫৯ ) বাংলার সুলতানের কর্তৃত্ব মেনে নেননি এবং তিনি পূর্বোক্ত সুলতানের অনুগ্রহপ্রাপ্ত লোকজনদের প্রতি বিরূপ ছিলেন।
১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দের পর আবার আরাকানের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। ১৬৬১ খ্রীষ্টাব্দের দিকে শাহ সুজার হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে মোগলদের সাথে আরাকান রাজার বিরোধ শুরু হয়। ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে মোগল বাহিনী চট্টগ্রাম ও রামু থেকে আরাকানী সেনা ও তাদের সহযোগী পর্তুগীজদের বিতারিত করে ।
১৬৬৯ থেকে ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত মোগল সর্দাররা পর্যায়ক্রমে আলীকদমে জুমিয়া জমিদারী পরিচালনা করেছিলেন। ফতে খাঁ ( ১৬৬৯ ) থেকে জালাল খাঁ ( ১৭১৬- ১৭২৪) প্রত্যেকে ছিলেন শাহ্ সুজার সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মাধ্যক্ষ বা সেনাপতি । রামুতে জমিদারী পরিচালনাকালে জালাল খার সাথে চট্টগ্রামের নবাবের সম্পর্কের অবনতি হলে এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের মোগল সেনাধ্যক্ষ কিষাণ চাদ ও শের জামাল খাঁ অভিযান চালিয়ে আলীকদমের সকল স্থাপনা ধ্বংস করে দিলে ১৭২৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে সেখানকার জমিদারী চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় । এর পর ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দে দেয়াঙ ( বর্তমান আনোয়ারা ) এর মোগল বংশীয় জমিদার শেরমস্ত খা আলীকদমে বসবাসকারী সহযোদ্ধাদের জন্য চট্টগ্রামের নবাব জুলকর খাঁর কাছ থেকে রাঙ্গুনিয়ার কোদালা এলাকার পার্বত্য ভূমি বন্দোবস্তি নিয়ে বসবাস ও জমিদারী প্রবর্তনের ব্যবস্থা করেন এবং উদ্বাস্তু চাকমা জুমিয়াদের জড়ো করে কোদালায় নিয়ে আসেন এবং চাষাবাদে নিয়োজিত করেন (পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস- জামাল উদ্দিন , পৃঃ ২১৯-২২০ )।
১৭৩৭ থেকে ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পরম্পরা কয়েকজনের পর মোগল বংশীয় শেষ জমিদার ধরম বক্স খার সময় Taungjyny রা আরাকান (?) থেকে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বসবাসের জন্য (রাজানগরে) এসেছিল । তাই এখান থেকে (১৮১৯ খ্র দাইনাকদের একটা অংশের ইতিহাসের বাঁক তঞ্চঙ্গ্যা নামে শুরু ।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে পরবর্তীতে তঞ্চঙ্গ্যার ইতিহাস দীর্ঘ না হলেও জটিলতা মুক্ত নয় । এ জন্য নিমে লিখিত কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক । যথাঃ(১) চাকমাদের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের সম্পর্ক । (২) চাকমাদের রাজা (ধরম বক্স খা) র নিকট আশ্রয়প্রার্থী হবার কারণ । এবং (৩) তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার সাথে বাংলা ভাষার সম্পর্ক ।
দৈনাক নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিতর্কিত ইয়ংজ কাহিনীর ভিত্তিতে সতীশ ঘোষ দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে লিখেছিলেন – “দৈনাকেরা যে চাকমাগনেরই অন্যতম শাখা , তাহা সর্ববাদিসম্মত” সতীশ ঘোষের এ লেখার প্রেক্ষিতে প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছেন তঞ্চঙ্গ্যারা চাকমাদের একটি শাখা । অর্থাৎ ইতিহাসের গতিধারায় একটি জনগোষ্ঠীর পরিচয়ে চাকমা নামের উৎপত্তি আগে এবং পরবর্তী সময়ে তাদের একটা অংশ দাইনাক নামে অভিহিত হয়েছে । ক্যাপ্টেইন লুইন এর মতে- “চাকমা নামটি চট্টগ্রামের অধিবাসীদিগেরই দ্বারা প্রদত্ত ” ( সতীশ ঘোষের বই এর পৃ : ৮ এবং জামাল উদ্দিনের বই এর পৃ : ১৬৭ ) । তা – ই যদি হয় , তবে দৈনাক নামটি কি ইহার পরে ?
কুমুদ বিকাশ চাকমা বর্ণিত আকিয়াব যাদুঘরে রক্ষিত মডেল থেকে যে একটা তথ্য স্পষ্ট বোঝা যায় তা হচ্ছে, আরাকানে প্রাচীন অধিবাসী কোন জনগোষ্ঠীর নাম ‘চাকমা ছিল না, ছিল দাইনাক। থেক / সেকদের পোষাকের সাথে চাকমাদের মিল থেকে এটুকু মাত্র বলা যায় যে থেক / সেকদের একটা অংশ বাংলার ভূমিতে আসার পর ‘চাকমা ‘ নামে অভিহিত হয়েছে । থেক / সেক ‘ এবং ‘ দাইনাক’ দুইটি ভিন্ন জনগোষ্ঠী । তদ্রুপ তঞ্চঙ্গ্যা ‘ এবং চাকমা ‘ ভিন্ন জনগোষ্ঠী।
অনলাইনে Daingnak ওয়েব সাইট এ দেখা যায় – দাইনাকেরা নিজেদেরকে Sangma বলেন । উখিয়া, টেকনাফ এলাকায় বসবাসরত তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের নামের শেষে চাকমা লেখেন । এ থেকে আবার দাইনাক, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে একই জনগোষ্ঠীর তিনটি শাখা বলে প্রতীয়মান হয় ।
চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার গ্রন্থে (পৃঃ ৬৬-৬৭) অশোক কুমার দেওয়ান লিখেছেন – ব্ৰহ্ম আরাকান ইতিহাস বরাবরই একটি ভারতীয় বংশোদ্ভূত শাক্য জাতি বা শাক বা সাক জাতির অস্থিত্ব কল্পনা করা হয়ে আসছে । আরাকানীরা সম্ভবত: তাদের প্রাচীন Legend এর ধারাকে অনুসরণ করে উত্তর দিক থেকে আগত যে কোন নবাগত বা অপরিচিত মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীকেই সাক নামে অভিহিত করতো।
আরাকানীদের উচ্চারণে শব্দের শেষে ব্যঞ্জনবর্ণ প্রায় উহ্য থাকে। তাই ‘ সাক ‘ উচ্চারণ প্রায় সাঃ এর মত হয়। রাজাকে বলা হয় মাং । সাক রাজাকে সাঃ মাং এবং সাক লোকদেরকে সাঃ মেও বলেন। সাঃ মেও বা চাকমাদের পূর্বসূরীগণ হয়তো কোন এক কালে সম্বক ( Sambawak ) নগরে বসবাস করেছিলেন । দাইনাকদের পূর্বপুরুষগণের ন্যায় তাদের একটা অংশ দশম / একাদশ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধ – বিগ্রহ ও রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে ১৪১৮ খ্রীষ্টাব্দে মাতামুহুরী উপত্যকায় এসে উপনীত হয়ে তথায় বসতি স্থাপন করেন। সম্ভবত : তদকালে গৌড়ে আশ্রিত রাজা মিঙ সউন এর প্রতি অনুগত ছিল বিধায় তারা গৌড়ের সুলতানের অনুগ্রহ লাভ করে আলীকদমের পার্বত্য ভূমিতে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন । বহু ঘাত – প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। ১৬৪০-৬০ খ্রীষ্টাব্দে কথিত ধাবানা নামে একজন সর্দারের নেতৃত্বে , তারা ‘ সাংমা ‘ নামে নতুনভাবে সংগঠিত হয়। সতীশ চন্দ্র ঘােষ তার চাকমা জাতির ইতিহাস গ্রন্থের ১ ম অধ্যায়ের ৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন- “ ধুর্যা , কুর্যা , ধাবানা , পীড়াভাঙ্গা ইত্যাদি নেতৃচতুষ্টয়ের নামানুসারেই সর্বপ্রথমে চারিটি গোষ্ঠী গঠিত হয় । এই চারিটি গোষ্ঠী লইয়াই বংশবিভাগ আরম্ভ হইয়াছিল । ধুর্য, কুর্যাদি নের্তৃবৃন্দ যাহাদের উপর প্রভূত্ব করিত, তাহারও চারিটি দলে বা গোছা’য় বিভিন্ন ছিল” লেখক এর পরে উক্ত চারিটি গছা থেকে শাখা – প্রশাখায় বর্ধিত চাকমাদের তদুকালে মোট একত্রিশটি গোছা ও ১৩৩ টি গুত্তির তালিকা দেন (পৃঃ ৫৬-৬০) উক্ত তালিকায় দাইনাক (তঞ্চঙ্গ্যাদের পুর্বেল্লিখিত ৭ টি গোছার নাম নেই । এ থেকেও বলা যায় -দাইনাক ( তঞ্চঙ্গ্যা) এবং চাকমারা ভিন্ন গোত্রজাত।
১৬৬০ এর পরবর্তী সময়ে শাহ সুজার অনুসারী সেনাদের উপস্থিতির ফলে দক্ষিন চট্রগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে । ১৬৬৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে তারা মোগল বংশীয় জমিদারগণের প্রজা হিসেবে পরিগণিত হয় । জমিদারগণের বাসস্থান ( রাজধানী ) পরিবর্তনের সাথে সাথে উক্ত চাকমা প্রজাগণও বাসস্থান বদলাতে থাকেন । জমিদারের নৈকট্যে থেকে চাকমা প্রজাদের মধ্য থেকে দেওয়ান , তালুকদার , খীসা প্রভৃতি খেতাব নিয়ে একটা ক্ষুদে সমস্ত শ্রেণি তৈরী হয় । সামন্তপ্রভুদের মত বিশেষ করে দেওয়ান স্থানীয় কর্তা ব্যক্তিরা সাধারণ প্রজাদেরকে তাদের সেবক বা হুকুমের পাসের মত গণ্য করত । অপরদিকে দাইনাকেরা নিজ নিজ গোত্র প্রধানদেরকে কেন্দ্র করে সম্ভবত : পূর্বের মাতামুহুরী উপত্যকা বা উহার নিকটবর্তী অঞ্চলে জুম চাষ করে যাযাবরের মত জীবন যাপন করেছিল । ফলত : তাদের মধ্যে অনুরূপ কোন শ্রেণি বিভাজন গড়ে উঠেনি। সে সময় মূলত : চাকমাদের দেওয়ান প্রভৃতি সামন্ত শ্রেণির লোকেরাই দৈনকদের প্রতি হেয় মনোভাব পোষণ করতো । হয়তো তাই সতীশ ঘোষের লেখাতে পাই- “ চাকমাগণ তাহাদিগকে আপন সমাজভূক্ত করিয়া লয় নাই , এমন কি বিবাহাদি কার্যে কোনরূপে ইহাদের সহিত সম্বন্ধ হয় নাই । চাকমারা সাধারণত : ইহাদিগকে এতটুকু ঘৃনার চক্ষে দেখিয়া থাকে। ” উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য সূচিত হবার ইহা আর একটা কারণ । উপরোক্ত চাকমা ও দাইনাকদের পূর্বপুরষগণ শত বর্ষ পূর্বে যদি একটা গোত্রের লোকও হতেন তবুও দুইটা জনগোষ্ঠীকে আলাদা গণ্য করার জন্য এই শ্রেণি বিভাজনের পার্থক্যই যথেষ্ট । পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে যে , জমিদার শেরমস্ত খা’র সময় ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে অধিকাংশ চাকমা আলীকদম এলাকা থেকে কোদালায় স্থানান্তর হয়েছিল । ধারণা করা যায় – জুমচাষে অভ্যস্ত দাইনাক লোকেরা হয়তো হাল চাষে অনীহার কারণে পূর্ব বসতি পাহাড় জঙ্গলের জায়গা ছেড়ে চলে আসেনি অথবা আসার পর আবার জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যত্র কোন পাহাড় – জঙ্গলময় এলাকায় চলে যায় । এ জন্যই হয়তো সতীশ ঘোষ আরো লিখেছিলেন- “ ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে রাজা জান বক্স খার শাসনকালে দৈনাকেরা পিতৃকূল পরিত্যাগ করিয়াছে ” । অর্থাৎ দৈনাকদেরকে তিনি চাকমা থেকে বেরিয়ে যাওয়া ( ! ) একটি শাখা হিসেবেই গণ্য করেছেন (১৬৪০-৬০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে উল্লিখিত গছাভিত্তিক সামাজিক কাঠামোতে চাকমাদের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের গছার ভিন্নতা বিবেচনায় এ বক্তব্য সমর্থনযোগ্য হয় না )
মাঝখানে ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে মোগল সম্রাটের নিকট থেকে পুরো ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যায় । জমিদার শের দৌলত খাঁ ( ১৭৬৫-১৭৭২ ) এর সময় থেকে টব্বর খা ( ১৭৯৮-১৮০১ ) পর্যন্ত চাকমাগণ বৃটিশ বিরােধী সংগ্রাম চালান । জমিদার জব্বর খা ( ১৮০১-১৮১১ ) এর সময় থেকে বৃটিশদের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে চাকমারা কিছুটা শান্তিতে বসবাস করতে পারে । সম্ববত : দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ থাকার কারণে দক্ষিণে রোয়াঙ ( রামু থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দক্ষিণ পূর্ব ভূভাগ এক সময় রোয়াঙ নামে পরিচিত ছিল) থেকে ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে রাজানগরে চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ’র নিকট এসে ৪০০০ দাইনাক আশ্রয়প্রার্থী হয়েছিল । (আমার বাবার কাছ থেকে ১৯৬৩-৬৬ খ্রীঃ সময়ে জেনেছি , তাঁর পিতামহ তারও পিতামহের মুখ থেকে শুনেছেন – রাজার অনুমতিক্রমে তাদের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ রোয়াঙ থেকে আগত লোকেরা প্রথমে চন্দ্রঘোনার নিকটে সীতা পাহাড় ও রাম পাহাড় এলাকায় জুমচাষ করে ছিলেন । সেখান থেকে এক অংশ ক্রমান্বয়ে উত্তরে ওয়াগৃগী এবং অপর অংশ পূর্বে কর্ণফুলীর উপনদী কাপ্তাই ও রাইংখ্যং এর দিকে ছড়িয়ে পড়েন )।
যে কারণেই হোক, কিছু লোক অন্যত্র চলে যায় । পরিসংখ্যান সূত্রের ভিত্তিতে জনসংখ্যা কিছু বৃদ্ধি পাবার কথা । অথচ ৫০ বছর পর ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে তাদের সংখ্যা অবশিষ্ট ছিল ২৫০০ (ক্যা, লুইন) । একান্তই স্বজাতি বোধে এসে থাকলে কিংবা দেওয়ান পরিষদ বেষ্টিত জমিদার তাদেরকে একই চাকমা জাতি গণ্য করলে তাদের বেশীর ভাগ লোক নিশ্চয় থেকে যেত।
১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে বার্মারাজ বোধাপায়া আরাকান দখল করে । বর্মীবাহিনী ব্যাপক গণহত্যা চালায় , কয়েক লাখ লোক আরাকান থেকে বিতারিত হয়ে বৃটিশ অধিকৃত পূর্ববঙ্গে , প্রধানত : চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসে আশ্রয় নেয়। ইংরেজ সরকার তাদেরকে দক্ষিণ চট্টগ্রাম (বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার) এবং পটুয়াখালিতে পূনর্বাসিত করে । ১৮২২ খ্রীষ্টাব্দে বোমাং তার মগ ( মারমা ) অনুসারীগণ সহ বান্দরবানে বসতি স্থাপন করেন। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অথবা উপরোক্ত উদ্বাস্তু লোকেদের আসার ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি হয়, হয়তো জুমচাষের পাহাড় ভূমি সংকুচিত হয়ে পড়ার কারণেও দাইনাকদের কিছু অংশ বসবাসের জন্য সমগোত্রীয় গণ্য করে উত্তরদিকে চাকমাদের কাছাকাছি এসেছিল । ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে আরাকান সহ সমগ্র বার্মা বৃটিশের অধীনে চলে যায় । সীমান্তের বাধা নিষেধ রইল না। বৃটিশ সরকার ইতিপূর্বে উদ্বাস্তু হয়ে আসা লোকজনদেরকে পূনরায় আরাকানে ফিরে যেতে উৎসাহিত করে। এটাও হতে পারে – যাযাবর জুমিয়া দাইনাকদের কিছু অংশ হয়তো তখন আরাকানে ফিরে গিয়েছিল।
১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে বর্তমান পর্যন্ত বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে প্রতিবেশী বাঙ্গালীদের সংস্পর্শে থাকায় চাকমাদের ভাষাতে বহুল পরিমানে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দ প্রবিষ্ট হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামে (১৬৬৬ খ্রীঃ পর্যন্ত আরাকানের অংশ) বসবাসের সময় এবং পরবর্তীকালে চট্টগ্রামী বাঙ্গালীদের সাথে প্রয়োজনে কথাবার্তায় দাইনাক / তঞ্চঙ্গ্যারাও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করতে শেখেন ( যে কারণে দাইনাক / তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে বিকৃত বাংলা বলে অনেকে মনে করেন ) এবং ধীরে ধীরে তাদের ভাষায় ঐ শব্দগুলো প্রবিষ্ট হতে থাকে । তাই ভিন্নভাষী , বিশেষ করে বাঙ্গালীদের নিকট চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাকে বিকৃত বাংলারূপে আপাত : একই রকম মনে হতে পারে । তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে চাকমাদের একটি শাখা বলে গণ্য করার পেছনে এটিও একটি কারণ । অথচ চাকমারাও তঞ্চঙ্গ্যা সাধারণের কথা অনেক সময় বুঝতে পারেন না । একশ ‘ বছর আগে সতীশ ঘোষের লেখা ( ১৯১০ খ্রীঃ) থেকে জানা যায়- তকালে তঞ্চঙ্গ্যা প্রাচীনেরা নিজেদের মধ্যে আরাকানী ভাষায় কথা – বার্তা বলে আর কম বয়সীরা চাকমাদের অনুকরণে বিকৃত বাংলায় বলে । এ থেকে ধারণা করা যায়- তঞ্চঙ্গ্যারা তাদের পূর্বপুরুষদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে । চাকমাদের বেলায়ও সে একই কথা প্রযোজ্য।
জমিদার ধরম বক্স খা’র মৃত্যুর (১৮৩২ খ্রীঃ) ১২ বছর পর রানী কালিন্দী জমিদারী লাভ করেন ( ১৮৪৪ খ্রী ) । জামাল উদ্দিন তার পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ( প্রকাশ কাল ২০১১ খ্রী ) গ্রন্থে ( পৃ : ১৫৬-২৫৭ ) লিখেছেন- “ জমিদারীর কর্তৃত্ব লাভের জন্য বিপক্ষীয়দের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রানীর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল তঞ্চঙ্গ্যারা । ” এ কারণে পরবর্তী সময়ের জমিদার তথা চাকমা রাজাগণ তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন বলে জানা যায় । শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা’র “ তঞ্চঙ্গ্যা জাতি ” গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি- চাকমা রাজা ভূবন মােহন রায় ( ১৮৭৬-১৯৩৪ খ্রীঃ ) কবিরাজ শ্ৰী পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যাকে রাজকবি উপাধিতে ভূষিত করে রাজসভায় সমাসিন করেন । রাজা নলিনাক্ষ রায় ( ১৯০২-১৯৫১ খ্রীঃ) শ্রীমৎ প্রিয় রত্ন মহাস্থবির ( গৃহী নাম পালকধন তঞ্চঙ্গ্যা ) কে রাজগুরু মর্যাদায় ভূষিত করেন । জয়চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ( যিনি কানা গিংখুলী নামে খ্যাত ) কে ‘ রাজুগিংখুলী ’ উপাধি দিয়ে প্রতিবছর রাজপূণ্যাহ উপলক্ষে রাজসভায় সমাসিন করতেন । রাজা ত্রিদিব রায় (১৯৩৩- ২০১৩ খ্রীঃ) ১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবির (গৃহী নাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা ) কে রাজগুরু পদে অভিষিক্ত করেন । উক্ত রাজাগণের সময়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি মৌজা হেডম্যানের দায়িত্ব ও ক্ষমতা লাভ করেন । একালের প্রতীকী ‘ রাজা ’ নামে চাকমা জমিদারগণ গুণীজনদের মর্যাদা দিয়েছেন , সম্মান রক্ষা করেছেন , তঞ্চঙ্গ্যা , গোত্র বা জাতিগতভাবে ভিন্ন কি না তা বিবেচনা করেননি।
বৃটিশদের পর ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে পূর্ববঙ্গ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের একটা অংশরূপে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিবর্তিত হয় । জমিদারী প্রথা রহিত হয় । সমাজে শ্রেনীগত স্তরবিন্যাসে পরিবর্তন ঘটে । কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু আধা – সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যায় । পূর্বোক্ত দেওয়ান তথা কর্তাব্যক্তিদের ক্ষমতা খর্ব হয় । তা সত্ত্বেও তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির (তঞ্চঙ্গ্যা জাতি- রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা , পৃ : ১১২ ) রেশ এর পরেও বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়েছিল । ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে চন্দ্রঘোনায় কাগজের কল বসে । ১৯৬০ খ্রীষ্টাব্দে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প শুরু হয় , কর্ণফুলী নদীতে বাঁধের জলে উজানে ৪০০/৫০০ বর্গমাইল এলাকা হ্রদে পরিণত হলে প্রায় ৫৪,০০০ একর আবাদী জমি জলমগ্ন হয়ে পড়ে । এতে ১৮,০০০ পরিবারের লক্ষাধিক লোক (অধিকাংশ চাকমা , কিছুসংখ্যক তঞ্চঙ্গ্যা এবং বাঙ্গালী ) ক্ষতিগ্রস্ত হয় । প্রায় ৪০,০০০ লোক ভারতে ( এদের বেশীর ভাগই চাকমা এবং কিছু সংখ্যক তঞ্চঙ্গ্যা ) এবং ২০,০০০ লোক আরাকানে চলে যায় । এসময় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী পরিচালিত ব্যবসায়িক কার্যক্রমের প্রসার ঘটে । এ ক্ষেত্রেও তঞ্চঙ্গ্যাদের তেমন কোন ভূমিকা দেখা যায়নি ।
পাকিস্তানের সময় থেকে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা প্রসার ঘটে । ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দে রামগড় হাইস্কুল , ১৯৫৩ খ্রীষ্টাব্দে চন্দ্রঘোনায় কে , পি , এম উচ্চ বিদ্যালয় , ১৯৫৭ খ্রীষ্টাব্দে রাঙ্গামাটি শহরে শাহ্ উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দে খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয় । রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় (স্থাপিত -১৮৯০ খ্রীঃ) সহ ১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দের শুমারীতে মোট উচ্চ বিদ্যালয় ৭ টি, জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় ১৪ টি, এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৬১ টি (পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস জামাল উদ্দিন , পৃ : ৩২৩) পাওয়া যায় । ১৯৬২ খ্রীষ্টাব্দে কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং ১৯৬৫ খ্রীষ্টাব্দে নতুন রাঙ্গামাটি শহরে একটি কলেজ স্থাপিত হয় ।
বলা বাহুল্য – বিদ্যালয়গুলো অধিকাংশ চাকমা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে স্থাপিত হওয়ায় সাধারণ চাকমা ছেলে-মেয়েরাই সে সুযোগ লাভ করে। মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক ব্যতীত তঞ্চঙ্গ্যাদের অধিকাংশই উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষালাভের সুযোগ নিতে পারেনি। ফলত: শিক্ষাগত দিক দিয়েও চাকমাদের সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয় ।
১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হল। বনায়নের জন্য বিস্তীর্ণ পাহাড় ভূমি অধিগ্রহণ, রাবার বাগানের জন্য ধনী ও প্রভাবশালী লোকদেরকে হাজার হাজার একর পাহাড় ইজারা প্রদান প্রভৃতি কারণে জুমচাষের ভূমি ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে জুমিয়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকেদের জীবিকা নির্বাহের প্রথান উপায় প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। তঞ্চঙ্গ্যাদের অধিকাংশ লোক ছিল জুম চাষের উপর নির্ভরশীল ; এখন তাদের একটা ক্ষুদ্র অংশ বাগান ইত্যাদি গড়ে তুলে অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে ; চাকরী , ব্যবসা প্রভৃতি পেশাতেও প্রতিযোগীতায় পিছনে পড়ে থাকে। অধিকাংশ দিন মজুরী থেকে শুরু করে যখন যা পাচ্ছে সে কাজ করে কোন রকমে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে । যাদের পক্ষে সম্ভব তারা ছেলে – মেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করছেন , যদিও মোট জনসংখ্যার তুলনায় তারা অনুমানিক ১০ % এর বেশী হবে না।
মূলত : জুম পদ্ধতির আদিম উৎপাদন ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল যাযাবর দাইনাক তথা তঞ্চঙ্গ্যা জনগােষ্ঠীর লোকজন হাজার বছরের জীবন পরিক্রমায় গোত্রগত তথা জাতিগত পূর্বপরিচয় ইতিহাসের ঝরা পাতায় রেখে এখন নতুন যুগে পরিবর্তিত ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর যাত্রা শুরু। দাইনাক / তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী যারা তিনশ ’ বছর পূর্বেও একই জাতিরূপে একই দেশে বসবাস করে ছিল , এখন তারা ত্রিধা বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ, মায়ানমার ও ভারত – এ তিনটা দেশের নাগরিক। ভিন্ন তিনটা দেশে তারা তিনটা ভিন্ন নৃ – গোষ্ঠী নামে পরিচিত হবে , নিজস্ব মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও সংস্কৃতিচর্চা না থাকলে উক্ত পরিচিতিও এক সময় হারিয়ে যাবে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এ সম্ভাবনাটা আরো বেশী প্রকট।
জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য, জ্ঞান অর্জনের জন্য স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেখা আবশ্যক; কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিবেশগত কারনে শিক্ষিত ছেলে – মেয়েরা নিজেদের ভাষা হারিয়ে ফেলছে , পূর্বে প্রচলিত ছিল এমন অনেক শব্দ তাদের কথাবার্তায় ক্রমাগত বাংলা অথবা ইংরেজী শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে । তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় কোন সাহিত্য – সংস্কৃতির চর্চা তেমন না থাকায় তাদের ভাষার সংরক্ষণ হচ্ছে না , বিকাশও ঘটছে না । চাকমা শিক্ষিত বুদ্ধিজীবিদের একাংশ এ বিষয়ে যথেষ্ট সক্রিয়, তারা চাকমা বর্ণমালা শিক্ষাদান সহ মাতৃভাষায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা বহু বছর পূর্ব থেকে শুরু করেছেন , প্রজন্ম পরম্পরা অব্যাহত রেখেছেন । তঞ্চঙ্গ্যা শিক্ষিত ব্যক্তি তথা বুদ্ধিজীবিগণ বলতে গেলে এখনো ঘুমিয়ে । আলাদা একটি জাতিসত্ত্বা হিসেবে তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে- এটা আনন্দের বিষয়; এটি দিয়ে তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে জাতি হিসেবে চাকমা থেকে আলাদা বলতে পারা যায়। কিন্তু ইতিহাসের গতিধারায় আমরা কী দেখতে পাই ? দাইনাক চাকমা তঞ্চঙ্গ্যা প্রাচীনেরা প্রায় সবাই বিশ্বাস করে আসছেন যে, সবাই (পূর্ব পুরুষগণ) একসময় চম্পক (সম্বক!) নগরে ছিলেন । কাব্য রূপে কিংবদন্তী রাধামন – ধনপদী কাহিনীও প্রত্যেকে নিজেদের পূর্বপুরুষগণের ইতিহাস (!) বলে মনে করেন । হয়তো দাইনাক, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের পূর্বপুরুষগণ অতীতে কোন এক সময় একই গোত্র বা জাতিভূক্ত ছিল । প্রবন্ধে আলোচিত বিবরণ অনুযায়ী এ কথা বললে সম্ভবত: ভুল হবে না- তঞ্চঙ্গ্যা / দাইনাকদের পূর্বপুরুষগণ (সর্দারগণ) সমকালীন পরিস্থিতি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারেননি বিধায় উত্তরসূরীগণ অগ্রযাত্রায় চাকমাদের তুলনায় পর্যায়ক্রমে পিছিয়ে পড়ে গিয়েছিল । ভাষা হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর জাতি হিসেবে গণ্য হবার প্রাথমিক ও মূল ভিত্তি , সংস্কৃতি হচ্ছে তার আবরণ । জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
লেখক- রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৭ ইংরেজী তে অবসরপ্রাপ্ত একজন সহকারী শিক্ষক । এবং সদস্য – সচিব, তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা আহ্বায়ক কমিটি (২০০৮ ইং গঠিত) ।