তিন দেশে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভৌগোলিক অবস্থান

আর্যজ্যোতি ভিক্ষু

সুচনা-

তিন দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত এবং মায়ানমারের একটা জনগোষ্ঠীর নাম তঞ্চঙ্গ্যা। তিন দেশে তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। মায়ানমারে দৈংনাক, বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গ্যা এবং ভারতে তঞ্চঙ্গ্যা বা চাকমা নামেই পরিচিতি লাভ করছে। তন্মধ্যে ভারতের ত্রিপুরায় সরকারি ভাবে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় তারা বিভিন্ন অফিস আদালতে চাকমা পদবী ব্যবহার করছে।

তঞ্চঙ্গ্যাগণ প্রায়ই ভুলে গেছে যে ভারত এবং মায়ানমারে তাদের জনবসতি রয়েছে। আশি দশকের দিকে তারা জানতে পারে যে, বাংলাদেশ ব্যতীত ভারত এবং মায়ানমারে তাদের জনবসতি রয়েছে। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগের মাধ্যমে তারা জানতে পারছে তঞ্চঙ্গ্যারা কে কোথায় এবং কী অবস্থায় বসবাস করছে। তবে তিন দেশটিতে আলাদাভাবে আদমশুমারি না হওয়ায় তাদের প্রকৃত জনসংখ্যার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় নি। এ প্রবন্ধে তিন দেশের তঞ্চঙ্গ্যারা কোন কোন রাজ্যে, কোন প্রদেশ বা কোন গ্রামে কোন কোন জেলায় বসবাস করছে তার বিস্তারিত আলোচনা থাকছে, তার আগে তঞ্চঙ্গ্যারা কিভাবে এ তিন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা থাকছে।

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস –

তঞ্চঙ্গ্যারা নিজেদের শাক্য বংশের বলে দাবি করে, মায়ানমার ইতিহাস মতেও তঞ্চঙ্গ্যারা শাক্য বংশের উদ্ভুত। সেই সময় আরাকান রাজা তাদের নতুন পরিচয় দেন দৈংনাক নামে। পরে তারা তৈনগাঙা থেকে তঞ্চঙ্গ্যা / তনচংগ্যা নামে পরিচিতি লাভ করে।

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন লেখক, ইতিহাসবেত্তা এবং পন্ডিতদের মধ্যেও মতভেদ রয়েছে। হি পিঙের মতে, (He Ping, 540) “সাক হলো একটি পুরাতন তিব্বতি-বর্মী দল যারা হোয়াং-হো নদী (হলুদ নদী) উজান দিক থেকে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে মায়ানমারের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়।” আবার মায়ানমারের ইতিহাস মতে, ৮৫০ খ্রীস্টপূর্ব শাক্য বংশের রাজা  অভিরাজা স-বংশে কপিলাবস্তু ত্যাগ করে মায়ানমারের উত্তর প্রান্তে তাগং নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেছিলেন।

ইতিহাস মতে, সেই শাক্য বংশের লোকেরা নুন্যতম দুই থেকে তিনশত বছর তাগং প্রদেশে বসবাস করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সেখান থেকে মিচ্ছাগিরি নামে ইরাবতী নদীর তীরে বসবাস করেন বলে উল্লেখ আছে। দান্যাওয়াতি আয়েদবুং নামক ইতিহাস গ্রন্থের তথ্যমতে, চৌদ্দ শতাব্দীতে আরাকান রাজা (মগ রাজা) শাক্য বংশের রাজার সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপনের কুমন্ত্রণায় একজন সুন্দরী কন্যা উপকার দিয়েছিলেন। খবরটা জেনে শাক্য রাজা খুশিতে আনন্দে সুরাপান করে মদ্যপায়ী হয়ে ওই রমণীর সাথে কাম সম্ভোগে লিপ্ত হন। সেই সুযোগে মগ রাজা শাক্য বংশের রাজ্যে আক্রমণ করে, এবং সগোত্র রাজাকে ধরে নিয়ে আরাকানে বন্দী করে রাখেন (১৩৩৩-৩৪ খ্রিষ্টাব্দ, ৬৯৫ মগাব্দ)। তখন শাক্য বংশীয় রাজা সৈন্যদল কালো রঙের ঢাল নিয়ে যুদ্ধ করতেন এবং সেই জন্য মগ রাজা শাক্য রাজাকে জরিমানাও করেছিলেন। কালো রঙের ঢালকে আরাকানী ভাষায় দাইন- নাক বলা হয়। তখন থেকেই শাক্য বংশীয়দের দাইন-নাক (দৈংনাক) নামে আরাকানীরা আখ্যায়িত করতো।

উপরোন্ত, উল্লেখিত মায়ানমারের ইতিহাস গ্রন্থ (পৃষ্ঠা-১৪) অনুসারে, শাক্য রাজার তিন পুত্র ছিল। পরবর্তীতে তারা শাক্য রাজ্য থেকে আরাকানের উত্তর পূর্বাঞ্চলে পালিয়ে গেছে। জ্যেষ্ঠপুত্র সা-ক্য নামক স্থানে আধিপত্য বিস্তার করেন। মধ্যম পুত্র সা-প্রেই শহরে বসতি স্থাপন করেন। কনিষ্ঠ পুত্র সাগাইন রাজার অধীনে বাস করায় রাজা তাম্মিক নামক এক শহর তাকে উপহার প্রদান করেন।

শ্রী রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যার “তঞ্চঙ্গ্যা জাতি” গ্রন্থ (পৃষ্ঠা ০৯) অনুসারে, আরাকানীরা খুবই অত্যাচার করত। সেই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ১৪১৮ খ্রীস্টাব্দে তারা সা-প্রেই পরিত্যাগ করেন। গভীর অরণ্যভূমি পার করে তারা জামাল উদ্দিন খাঁর রাজত্বকালে চট্টগ্রামে পৌঁছেন। তিনি ১২ খানি গ্রামে ১২ জন তঞ্চঙ্গ্যা তালুক/আমু (গ্রাম প্রধান) নিয়োগ করেছিলেন। সেই বারোটি তালুক/আমু বারোটি গছা সৃষ্টি হয়েছিল। যেমন- ১. কার’অয়া গসা, ২. মু’অ গসা, ৩. ধন্যা গসা, ৪. মংহ্লা গছা, ৫. হ্লাং গসা, ৬. মেলং গসা, ৭. অঙ্য গসা, ৮. লাপুস্যা গসা, ৯. তামুলুক গসা, ১০. রাঙ্গি গসা, ১১. তাসসি গসা,  এবং ১২. আঙু গসা।

পরলোকগত শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যার “তঞ্চঙ্গ্যা পরিচিতি’র (পৃষ্ঠা- ১১) তথ্যানুযায়ী, প্রথম শাক্য দলের সাথে আরও একদল শাক্য পশ্চাদ গমন করেছিলেন লামা, মহকুমা এবং অন্যান্য জায়গায়। দ্বিতীয় দল প্রথম দলের সাথে সাক্ষাৎ না পাওয়ায় তারা আবার আরাকান ফেরত যায় এবং এখনো সেখানে অবস্থান করছে।

চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁর আমলে দৈংনাকদের ফা-ফ্রু নামে একজন দলপতি ৪,০০০ জনকে সাথে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করেছিল। তারা রাজাকে একজোড়া হাতি আর অলংকার উপঢৌকন দিয়ে সেখানে বসবাসের অনুমতি পায়। এছাড়াও দৈংনাকগণ সবাই মিলে চাঁদা উত্তোলন করে পর্তুগিজ নির্মিত লাল বাড়ি (বর্তমান চট্টগ্রাম শহরের ডিসি বাংলো) ক্রয় করে রাজা ধরম বক্স খাঁকে উপহার দিয়েছিল। কিন্তু রাজা ধরম বক্স খাঁ তাদেরকে শাক্য বা চাকমা হিসেবে স্বীকার না করে “তৈনগাঙ্যা” নামে সরকারি দলিলে নথিভুক্ত করেছিলেন। কারণ তারা তৈনগাঙ/তৈনছড়ি থেকে আসছিল। রূপক দেবনাথের মতে, “তঞ্চঙ্গ্যারা তৈন-খ্যং বা তৈনগাঙ/ তৈনছড়ি (মাতামুহুরি নদীর উপনদী) অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপন গড়ে তোলার সম্পর্ক ছিল (পৃষ্ঠা-৫৫)।” দেবনাথ এও মত দেন যে, “তারা মাতামুহুরি উপত্যকা (পার্বত্য চট্টগ্রাম) -র উপরে অংশে বসবাস করার জন্য আরাকান থেকে আসছিল, পৃষ্ঠা-৫১।” শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা মতে, দৈংনাকেরা চাকমা হিসেবে গণ্য না হলেও রাজার প্রজারূপে তাদের পালন করেছিলেন। তারা নিশ্চয়ই তৈনগাঙ বা তৈনছড়িতে বহু বছর ধরে জীবনযাপন করছিলেন।

রাইংখ্যং উপত্যকায় তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস আনুমানিক এক থেকে দুইশো বছর ধরে। বাবু রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা তাঁর তঞ্চঙ্গ্যা জাতি গ্রন্থে (১৪ পৃষ্ঠা) উল্লেখ করেন, তঞ্চঙ্গ্যারা প্রথম অভিযান করেছিল ধরম বক্স খাঁর আমলে (১৮১২-৩০ খ্রীস্টাব্দ) শ্রীধন আমুর নেতৃত্বে, ৩০০ পরিবার নিয়ে। তারা সোনা, রুপা এবং নানান অলংকার উপঢৌকন দিয়ে সাক সার্কেলে বসতি স্থাপনের অনুমতি পায়। তারা নিশ্চয় রাইংখ্যং উপত্যকায় বসবাস করেছিল। কারণ, রাইংখ্যং উপত্যকা তঞ্চঙ্গ্যাদের খুব সুপ্রাচীন জনপদ। সেই সময় রাইংখ্যং উপত্যকা ছিল গভীর জঙ্গলে ভরা, বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য এবং বেশ উর্বর। হাঁড়ি ভরা মাছ, গোলাভরা ধান ছিল, কিন্তু চুরি ডাকাতি, বহিশত্রুর আক্রমণে এবং লুটপাটে জনজীবন নিরাপত্তাহীন।

প্রায় শত বছর পর রাইংখ্যং অঞ্চল থেকে ঠেগা নদী হয়ে কিছু তঞ্চঙ্গ্যা ভারতের মিজোরাম প্রদেশ, কিছু ত্রিপুরা রাজ্যে পৌঁছেছিল। ধারণা করা হয়, সেটা ছিল চাকমা রাজনীতিবিদ বাবু স্নেহ কুমার দেওয়ান (১৯৪০ খৃষ্টাব্দ) বিপ্লব চালিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা কালীন সময়ে। তবে আরও কিছু সময়ের পরে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধে নির্মাণোত্তর অনেক তঞ্চঙ্গ্যা মিজোরাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে পালিয়ে গিয়েছিল।

১৯৬০ খৃস্টাব্দে কিছু তঞ্চঙ্গ্যা রাইংখ্যং অঞ্চল ত্যাগ করে বান্দরবানের মহকুমা, রোয়াংছড়ি, বালাঘাটা, রেইছা, প্রভৃতি স্থানে বসতি গড়ে তুলেছিল। দৈংনাক/তঞ্চঙ্গ্যাগণ কপিলাবস্তু ত্যাগ করে আরাকান, পরিশেষে বাংলাদেশ এবং পুনরায় ভারতে পৌঁছেছিল।  অতপরঃ ভারত-বাংলাদেশ-

মায়ানমার এই ত্রিদেশীয় সীমান্তেই তঞ্চঙ্গ্যাদের স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠেছিল। সবকটিই দেশে তারা পরিনত হলো বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাঝে ক্ষুদ্র জনজাতি হিসেবে।

তঞ্চঙ্গ্যাদের ভৌগোলিক অবস্থান এবং জনসংখ্যা-

এখন পর্যন্ত তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা নিয়ে শুমারী হয়েছিল, তা সবই বাংলাদেশে। তাই বাংলাদেশের তঞ্চঙ্গ্যাদের সংখ্যা কত তার ছোট্ট একটা ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু ভারত এবং মায়ানমারের তঞ্চঙ্গ্যাদের সংখ্যা সম্পর্কে কোন প্রকার ধারণা পাওয়া যায় না।

ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইনের মতে ১৮১৫ সালে তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা ছিল ২৮০০ এর মতো। তবে চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ আমলে দৈংনাকদের একজন ফা-ফ্রু নামে ৪,০০০ জন দৈংনাক /তঞ্চঙ্গ্যা নিয়ে মায়ানমার হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম এসেছিলেন। খুব সম্ভবত ক্যাপ্টেন টি এইচ লুইনের গণনার পরবর্তীতে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে পৌঁছেছিল। Evaluation of Integrated Community Development Programme এর তথ্য মোতাবেক ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা ছিল ১৯,২১১ জন। বাংলাদেশের আদমশুমারী অনুযায়ী ২০০১ এ তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা ৩১,১৬৪ জন। অপর এক হিসাবে দেখা যায় ২০১২ সালে বাংলাদেশের তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা ৫১,৭৭৩ জন। (প্রথম আলো/ ৩ রা ফেব্রুয়ারি -২০১২)।

বাংলাদেশের তঞ্চঙ্গ্যাদের জনপদ সমূহ জানা যাক-

Tanchangya-people-by-Heronmoy-Tanchangya-Emon-768x512.jpg

রাঙামাটি সদরে- রোইন্যা ছড়ি, ঝগড়াবিল, দীঘলছড়ি, রাঙ্গাপানি, বৈয়াল্ল্যা(মানিকছড়ি), সোনারাম কার্বারি পাড়া, আমছড়ি মৈইন, কলা বোন্ন্যা, ডলুছড়ি মৈইন, বল্টু গাছ মৈইন, কলাবুন্যা আদাম, অগৈয়াছড়ি।

কাপ্তাই উপজেলা (রাঙামাটি)- বৃহত্তর ওয়াগগা (চিয়ন পাউলী, দেত্তাছড়ি (উত্তর দক্ষিণ), কুকিমারা, হাতি মারা, আমলকি ছড়া, তিবিড়া ছড়ি, সাপছড়ি, সাপছড়ি মৈইন, করুইতলী মৈইন, আগুনীয়া ছড়া, কাট্টলতলী, বটতলী, বড় পাউলী, গসনি (গর্জনিয়া), রাম পাহাড়, নুন ছড়ি মৈইন, বাইনালা, তিনছড়ি, ওয়াগগা যৌথ খামার, ইজ্জ্যাতলী, ওয়াগগা হেডম্যান পাড়া, বারঘোনিয়া তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া,  শিল ছড়ি, ব্যাঙছড়ি, দিউল ছড়ি, উড়িং ছড়া (হরিণ ছড়া), আড়া ছড়ি, ভাঙামুড়া, কারিগর পাড়া, কালা মাইচ্যা, ভালুক্যা, তিনছড়ি, রামা ছড়া, বড় ভালুক্যা, মিদি ছড়া, সাক্যয়া।

কাউখালি উপজেলা (রাঙামাটি)-

বয়া পাড়া (বগা পাড়া), সাক্কাছড়ি (সাক্রাছড়ি),  ঘাগড়া, চরা পাউলী, দেবাংখিলি, মঁয়াছড়ি (মগাছড়ি)।

রাঙ্গুনিয়া (চট্টগ্রাম)- রৈইস্যাবিলি,  চুচিলাবিলি, বেতছড়ি, ধর্মকূয়া।

রাজস্থলী উপজেলা (রাঙামাটি)- সদর উপজেলা, ঘিলা ছড়ি, ডাক্তর পাড়া, নাড়া ছড়ি, হেডম্যান পাড়া, ঝামদি মৈইন, কাঁকড়াছড়ি (অনেক গ্রামের নাম জানা যায় নি)।

বিলাইছড়ি উপজেলা (রাঙামাটি)- সদর উপজেলা, কুতুব দিয়া, তিন কোণিয়া, শাক্রাছড়ি, ধূপশীল, ফারুয়া, উড়াছড়ি, তক্তানালা, সুক্কছড়ি, গোয়াইন ছড়ি, এগুজ্জ্যাছড়ি (অনেক গ্রামের নাম জানা যায় নি)।

তাছাড়া রাঙামাটি উপজেলার জুরাছড়িতে দুমদুম্যা, নতুন বাজার এবং বরকলেও কিছু তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার বসবাস করছে।

বান্দরবান জেলার- সদর উপজেলা, বালা ঘাটা, কালা ঘাটা, রেইছা, সাতকমল পাড়া, সুয়ালক, টাইগার পাড়া, তুম্ব্রু পাড়া, সিনিয়র পাড়া, তঙ্কাবতী এবং রমতিয়াসহ প্রভৃতি স্থানে প্রায় ১৬ হাজারের মতো তঞ্চঙ্গ্যা বসবাস করছে।

অপরদিকে, বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি, আলিক্ষ্যং, তৈনছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা প্রভৃতি স্থানে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসতি আছে।

কক্সবাজার জেলার উখিয়ার তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামের নাম হলো- মনখালী, মতেরবুনিয়া, শীলছড়ি, মোছারখোলা, তেলখোলা এবং টেকনাফ উপজেলায় শিল খালি, মনখালি, হরিখোলা, আমতলী, লম্বা ঘোনা, পুতিবুনিয়া, কাটাখালী ও নাটলীখোলা প্রভৃতি স্থানে প্রায় ৭ হাজারের অধিক তঞ্চঙ্গ্যাদের বাস আছে।

বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা যদিও অর্ধলক্ষাধিক বলা হচ্ছে প্রকৃত অর্থে তাদের সংখ্যা তার অধিক হবে।

ভারতের মিজোরাম Lawngtlai, Chakma Autonomous District Council ও  Lai Autonomous Council মিলে তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা প্রায় ৮০০০ সামান্য বেশি। সেখানকার তঞ্চঙ্গ্যাদের গ্রামের নামগুলো- ১. বন্দুকভাঙা, ২. বড় কলক বা শিলছড়ি, ৩. ওল্ড ছিপ্পুই, ৪. নিউ ছিপ্পুই, ৫. দাম্পেই, ৬. বিল্লছড়া, ৭. চিগন গুই ছড়ি, ৮. গেরাছড়ি, ৯. ছেড়া আদাম, ১০. ফুল ছড়া, ১১. লম্পুইঘাটা, ১২. বাসিথলাং, ১৩. বড় থলি, ১৪ খবাখালী, ১৫. লম্বা ছড়া, ১৬. মিনাবাপ ছড়া, ১৭. কুকুর দুলিয়া, ১৮. সমনি ছড়া, ১৯. বেতবুন্যা, ২০. বড় গুইছড়া, এবং ২১. দুরছড়া।

লাই জেলার তঞ্চঙ্গ্যাদের গ্রাম- ১. সাইখতলী, ২. দুমজাউ, ৩. সেকুলকাই, ৪. এম কঁপুই, ৫. সাইবহ্ ৬. চিকুরলুই, ৭. বাঙ্গাইল্যা আদাম, ৮. ভাসেকাই, এবং ৯. ঙালিম লুই।

ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ দিকের জেলা গমতি এবং দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলায় তঞ্চঙ্গ্যাগণ বসবাস করছে। উত্তর ত্রিপুরা ও ধালাই জেলাতেও তঞ্চঙ্গ্যা বসতি রয়েছে। তবে সরকারি ভাবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় তারা চাকমা পরিচয় ব্যবহার করে থাকে। সেখান কার তঞ্চঙ্গ্যা গ্রাম গুলি –

images

থুইকারাম, পূর্ব মানু, ডুল্যা ছড়ি (বড় আদাম), দেবিপুর, খাক্লাই, ছগড়িয়া, খসকছড়া, গাবুরছড়া, আদিপুর এবং রতনপুর প্রভৃতি। সেখানে আনুমানিক প্রায় ৮,০০০ মতো তঞ্চঙ্গ্যাদের বসতি রয়েছে।

এবারে মায়ানমারের দৈংনাকদের (তঞ্চঙ্গ্যা) গ্রামগুলোর নাম অঞ্চলভেদে উল্লেখ করা হলো;

Kali Kumar.jpg

ক. বুসিডং অঞ্চল- ১. তাইমাই চুঅং, ২. চং- চ রআ, ৩. লং চুং, ৪. প্রিঁং চুং, ৫. নাখাইন ডং, ৬. হঅং চুং, ৭. মিংক্যঙং স্বী, ৮. বডঁ, ৯. ইয়াং বং, ১০. রোয়া চিয়া, ১১. পায়েং গুমা, ১২. হ্লালেং চুং, ১৩. ডু ধাঁই, ১৪. পোক্কাইজ, ১৫. চাকমা উঁগাই, ১৬. পিরাক প্যে, ১৭. সাং চুং, ১৮. সা ইন প্রা, ১৯. মেয়াইন ঝারি, ২০. বাহু প্রাং, ২১. পোক ক্যে ওয়া, ২২. উ প্রো, ২৩. রেঃ কেউয়া, ২৪. মং নে রোয়া, ২৫. লং লু কং, ২৬. রোয়া হ উং, ২৭. ঙা ম্রা বঅ, ২৮. কালাবি মরং, ২৯. কথি হ্লা, ৩০. রোয়া সেইক, ৩১. বাবুং, ৩২. বা ধ ঘা, ৩৩. নেয়ং চুং, ৩৪. সাবাইক ডং, ৩৫. বুথিডং টাউনশীপ, ৩৬. তং ম রোত, ৩৭. আতং ফ্রা, ৩৮. কাং চুং, ৩৯. তিঁ তং প্রাং, এবং ৪০. কোয়াইঁ চুং।

খ. মাম পিয়া অঞ্চল- ১. ইয়াং বম ওয়াইং, ২. উ পিং ডং, ৩. সোসেয়া ডং, ৪. পেয়াইঁ ম্রং, ৫. লাক পা ইন গং, ৬. জি গং, এবং ৭. মি জি পাং চুং।

গ. ক্যক-থ অঞ্চল- ১. লিসাইন ডং, ২. ক্যাক ত টাউন শিপ, ৩. রোয়া মা প্রাং, ৪. ডুখাই চুং, ৫. সা- পেই গং, ৬. পুং ডাইন, ৭. ক্যক ডাইন, ৮. পেয়াইং ম্রং, ৯. আলি জয়াইঁ।

ঘ. মং থ অঞ্চল- ১. মিচিক ২. সং ভালা, ৩. তং মুরো, ৪. রে চুং প্রাং, ৫. থামা-ইন থা, ৬. সুই হ্লা আয়্যে ৭. রাঙ্গা জি জি, ৮. উই হ্লা ডং, ৯. মাঙ্গালা লুইয়ন, ১০. অং থা ব্রে, ১১. সালেই ডং, ১২. রানং ঙাসা।

ঙ. ম্রক উ অঞ্চল- ১. নাইং জ, ২. রঅ পুং গং, ৩. মিজলি গং, ৪. অং রে,

চ. পুন্যা ক্য উইন অঞ্চল- ম্রাং ড

ছ. পালা ওয়া অঞ্চল- ১. থাথি গং, ২. থাঘা চুং, ৩. রে আয়্যে চুং। এছাড়া আরও কয়েকটা গ্রাম অজানার কারণে বাদ পড়তে পারে।

সুতরাং তিনটি দেশে (বাংলাদেশে ৮০,০০০ জন, ভারতে ১৭,০০০ জন এবং মায়ানমারে ৮০,০০০ জন) মোট তঞ্চঙ্গ্যাদের জনসংখ্যা ১,৭৭,০০০ জন।

উপসংহারঃ

তঞ্চঙ্গ্যাদের ইতিহাস বিষয়ে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও, মায়ানমারের ঐতিহাসিক পুস্তক থেকে উদ্ধৃত বিভিন্ন তথ্যাবলী সঠিক বলে ধারণা করা হয়। কারণ মায়ানমারে এখনো প্রায় ৮০,০০০ তঞ্চঙ্গ্যা রয়ে যাওয়ায় (যাদের দৈংনাক বলে সেখানকার সবাই চিনে) মায়ানমার ইতিহাস গ্রন্থে তারা ঠাঁই পেতে সক্ষম হয়। তাদের ভাষা, পোশাক, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে বাংলাদেশ ও ভারতে অবস্থানরত তঞ্চঙ্গ্যাদের সাথে এখনো মিল রয়েছে৷

[বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ তঞ্চঙ্গ্যাদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যের কিছু ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকতে পারে, এক্ষেত্রে আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য]

Toingang
Toingang
Articles: 55

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *