প্রবাদ ও তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদের সাংস্কৃতিক অভিমুখ

ড. মনিরুজ্জামান (সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)

বাংলা ভাষা ও পার্বত্যজাতির ভাষার মধ্যে গোত্রগত বা নৃতাত্ত্বিক সূত্রের ব্যবধান যোগাযোগসূত্রকে কখনও খন্ডিত বা ব্যাহত করে নি। তার একটি প্রমাণ প্রবাদে ব্যবহার-সমতা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তুলনামূলক পঠন পাঠন প্রক্রিয়ায় বিচার করে ধারণা দিতে চেষ্টা করেছিলেন যে বাংলাদেশের ‘হাঁউ মাঁউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁও’ জার্মান শিশুদের কাছেও নিজস্ব জিনিষ হয়ে আছে এবং কখন কিভাবে এই নৈকট্য সৃষ্টি হয়েছিল তা অনুসন্ধানের বিষয় মাত্র। কিছুদিন আগে তুলনামূলক সংখ্যা বিচার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গণিত ভাষাবিজ্ঞানীগণ অবাক হয়ে দেখেছেন যে সংখ্যাশব্দ ভ্রমণশীল (এ বিষয়ে ‘ভাষাতত্ত্ব অনুশীলন’ গ্রন্থে আমার বিস্তারিত আলোচনা আছে।)

একইভাবে পূর্ব ইউরোপে যাঁরা লোকসাহিত্য নিয়ে তুলনামূলক কাজ করেছেন তাঁরা এই বিষয়টা আরও বিস্তৃতভা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং সে সব তাত্ত্বিক ও বিশ্লেষণমুলক আলোচনা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে Broken down myth theory, Historical- geographical contact theory বা ফিনিশিয়ান তত্ত্ব প্রভৃতির মধ্যে। এসব তাত্ত্বিক ধারণা এখন আরও প্রসার লাভ করেছে এবং আমেরিকা ও বিশেষত ফিনল্যান্ডে অনেক অগ্রসরতা ঘটেছে। Tribal Culture  নিয়েও দক্ষিণ ভারতে এবং Red Indian  দের বিষয় গাম্পার্জের বিষয় অনুসৃত ধারায় নৃ-ভাষাতত্ত্বে এবং এলার্ন ডান্ডি, লী উটশী প্রমুখ লোকবিদগণের হাতে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

বাংলাদেশ অজস্র ও বৈচিত্রশালী লোকউপাদানের দেশ। কিন্ত এদেশের সম্পদ নিয়ে শিক্ষা সংস্কৃতির জগত এখনও নিশ্চুপ। একদা রামোঁলার কথায় আমাদের প্রত্যয়ের কিছুটা প্রসার ঘটেছিল। মূলভূখণ্ডের বিষয় নিয়ে কিছুটা নাড়াচাড়া করা গেলেও (যথা-বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘লোকসাহিত্য’ সিরিজ, ইত্যাদি) আমাদের নিকট প্রতিবেশীদের লোকগত প্রথা ও জ্ঞান নিয়ে কখনও কেউ কোন কৌতুহল বোধ করেন নি। ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ- এর ‘কর্ণফুলি’-র পথ নিয়ে এই তথ্য উন্মোচনের শুরুটা ঘটেছিল, পরবর্তীকালে সে পথর খননী কাজ আর বেশীদূর অগ্রসর হয়নি। পার্বত্য সংস্কৃতিকে মূল সাংস্কৃতিক ধারা থেকে সব সময় দূরে রাখা হয়েছে। নৈকট্য সৃষ্টির পরিবেশ গড়ে ওঠেনি কখনও। এই চিত্র কেবল বাংলাদেশেরই নয়; রেড ইন্ডিয়ানদের দেশ সহ সর্বত্রই একই চিত্র; কেবল মাত্রা ভেদ।

সাঁওতাল, ত্রিপুরা ও অন্যান্য সমতলীয়তা মিশ্র সমতলী ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর সাথে বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য এলাকার নৃ-গোষ্ঠীগুলির ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন -যাপনের পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। একসময় আরাকান-ব্রহ্মদেশের সাথে এদের একটা সংযোগ ছিল এবং তারও আগে।

দক্ষিণ চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সাথেও যোগসূত্রটি গভীর ছিল এই সব জনগোষ্ঠীর। তাদের মধ্যে যারা স্থায়ীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে (বৃটিশ আমলে ও পরেও যাকে CHT বলা হত প্রশাসনিক সুবিধার্থে) বসতি স্থাপন করে অদ্যাবধি স্থায়ী হয়ে আছে, অর্থাৎ লুসাই কুকি প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর অংশ বিশেষ যারা সিলেট ও আসামের দিকে বসতান্তরিত হয়েছে তদের কথা বাদ দিয়ে,- অন্যদের সাথে স্থানীয় অধিবাসী ও মূল ভূখণ্ডের প্রশাসকদের রাজনৈতিক ছাড়াও আর্থ (বাণিজ্য ঘটিত)- সামাজিক সম্পর্কটি ছিল হার্দ্য এবং দীর্ঘ দিনের। রানীর হাত, মহামুনি, কাপ্তাই বা রাজস্থলী এমনকি বান্দরবান অদ্যাবধি পাহাড়ী ও সমুদ্রতীরের বাসিন্দাদের মিলনস্থান হয়ে আছে এই ভাবেই। এই স্থানের বার্ষিক মেলাগুলি উভয় জনগোষ্ঠীর জন্যই আজও আকাঙ্ক্ষিত। তথাপিও ওপর ও নীচের বাসিন্দাদের মধ্যে সাংস্কৃতিকভাবে সেই নৈকট্য সূচিত হয়নি- ভাষাতত্ত্বে যাকে বলা হয় Linguistic Convergence এবং নৃতত্ত্বে Acculturation; এর কোনটাই সৃষ্টি হয়নি দীর্ঘকাল পাশাপাশি অবস্থানের পরেও। সে কি কেবল উভয় জাতির অন্তর্গত রক্ষণশীলতা না অন্য কিছু?

অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যায় পার্বত্য জাতির অনেকেই একটি মধ্যবর্তী ভাষাও ব্যবহার করে থাকেন, অথবা সেই রকম কোনও মিশ্র বুলি বললে তারা তা বোঝেন এবং প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এটাই স্থানীয়ভাবে ‘ফাংশনাল’ বা বঙ্কিমচন্দ্রের পরিভাষায় বলা যায় ‘কার্যকারিনী’ ভাষা বা প্রকাশ। ভাষা হিসেবে তা স্পষ্ট নয়, কিন্তু পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের জন্য তা মোটামোটি কার্যকরী। তুলনা দিয়ে বলা যায়, আলতামিরা গুহায় যে চিত্রলিপি বা রেখাবয়ব পাওয়া যায় তা যেমন লিপিও নয় চিত্রকর্মও নয়, কেবলমাত্র টোটেমের নিদর্শন ও যাদুধর্মের বিকাশ,- ভাষার ক্ষেত্রে আদি মানুষের অভিব্যক্তিও সেই রূপ অর্থাৎ অন্যের কাছে নিজেকে উপস্থিত করারই একটা চেষ্টা। ‘ইন্দ্রধ্বজ’ দেখিয়ে অসুর বা সাধারণ মানুষকে দূরে রাখার চেষ্টা বিশুদ্ধ নাটকে থাকলেও ‘নাটগীতে’ তা থাকেনা। সে রকম সাধু বা শিষ্ট ভাষার শিক্ষণ বা ব্যবহার যাদের নেই তার গড়ে তুলে ‘লোকভাষা’? এখানে বুঝাতে চেয়েছি ভাষা সংস্কৃতির অংশ, কিন্তু মুখে বলা আর মুখের কথাকে স্থায়ী করার মধ্যে প্রভেদ আছে। সেই প্রভেদ সূত্রই ভাষাকে সীমিত করে আর ভাষিক উপাদানকে অন্যের অংশীদারিত্বে নিয়ে যায় আরো দূর। তখন বাংলার রাক্ষস জার্মানেও হাঁউ মাঁউ করে, প্রকাশ ভঙ্গী যেমনই হোক। India Theory-তে এভাবেই জার্মানী লোক উপাদান আর ভারতীয় লোক উপাদানে সমতা দৃষ্ট হয়। লোক সাহিত্যের অনেক শাখা, অনেক তার বিস্তার। কিন্তু সব শাখাই ভ্রমণশীল নয়। আবার Cosmic Theory অনুযায়ী অনেক বস্তুই স্বতোঃস্ফূর্ত কিংবা ‘সাধারণ’ হিসাবে জাত। ‘শাদীর রাতে বিড়াল মারা’ রেড ইন্ডিয়ানদের জীবনেও That’s for once’ গল্পে পাওয়া যায়, কেবল ‘বিড়াল’ এর স্থলে সেখানে এসেছে ‘ঘোড়া’। আবার অনেকের মতে এবং এই মত সর্বজন স্বীকৃত যে লোক-সাহিত্য বা সংস্কৃতি জিনিষটা খুবই স্থানিক- Insularity তত্বে সে কথা প্রমাণিত। পাশাপাশি থেকেও দুই গোত্র বা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জগৎ ভিন্ন থাকে। এটা নদী-পর্বতের মত প্রাকৃতিক বাধা বা Sibolethistic পরিবেশের কারণেও হয় বা হতে পারে, তেমনি আবার স্বতন্ত্র ‘Cultural Area’ (তুলনীয়: ‘India is a cultural Area’- E.B Emenw) বা ‘Sub-Area’-র কারণেও হতে পারে। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বা সীতাকুণ্ড, নোয়াখালীর ভৌগোলিক অবস্থানগুলি এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে দূরত্বের মাঝে নৃতাত্ত্বিক প্রসঙ্গটিও বিদ্যমান। কিন্তু মনে রাখতে হবে চাকমাদের বা তঞ্চঙ্গ্যাদের সাথে সেই দূরত্বা প্রকৃত প্রস্তাবে কোন বাধা হয়ে থাকে নি। অথচ অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর সাথে সেটাই কম বেশি প্রধান বাধা হয়ে আছে। Comearative Folk Studies আমাদের সে তথ্য বিচারে সহায়ক হতে পারে। আইরিশ লোকবিদ পাদরী জেমস লঙ্ বাংলা প্রবাদ সংগ্রহ ও আলোচনার যেমন অন্যতম অগ্রপথিক, রাশিয়ায় অবস্থান কালে তেমনি তিনি রুশ প্রবাদ নিয়ে তিনি তেমনি শ্রেণীকৃত ও তুলনামূলক আলোচনা করেন। দুষ্প্রাপ্য হলেও মহাদেব প্রসাদ সাহা ঠিকই বলেন, তাঁর আলোচনা এখনও আমাদের জন্য আদর্শ বিশেষ।

বলা হয় প্রবাদ আদি সমাজের সৃষ্টি। প্রাক-সভ্য সমাজে মানুষ কি জ্ঞান-বৃত্তির চর্চা করতো? যেহেতু প্রবাদ Folk wisdom-এর ভান্ডার তাই সে কথা মেনে নিতে হয় এবং বিশ্বাস করতেই হয়। যেমন কৃষি জীবনের বিষয়গুলো যা আসলে যাদু নির্ভরতার শিকারী জীবন (গুহাবাস) এবং আরও পরে পশু পালনের জীবন ও পশুচারণ ক্ষেত্রে সন্ধানে যাযাবর জীবন যাত্রার পরবর্তী জীবনেরই কে বাস্তবতা। তবে শুরুতে সম্ভবত সে জীবনও ছিল অধিক সংগ্রাম মূখর ও অনিশ্চিত এবং তাতে প্রাপ্তি ছিল কম। মানুষ স্থায়ী, অধিকতর নিশ্চিত ও সঞ্চয়ী জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয় যখন পশু মড়ক ও অতিরিক্ত পশু নিধনের ফলে অবিকল্প কৃষিজীবন তর কাছে সত্য হয়ে ওঠে। সূর্যদেব, মেঘদেবতা, জননী ধরিত্রী-চিন্তা এবং ক্রমে পুরাণ-তত্ত্বের(মিথলজি) কল্প-বাস্তবতায় প্রবেশ ঘটলো তার। দলবদ্ধতা আগেই ছিল, এখন বহু দলের সমাজ গঠন, আত্মরক্ষার্থ ও সঞ্চিত সম্পদ রক্ষার্থ প্রভৃতি পূজা, কৌম সমাজ রক্ষার ব্যবস্থায় নতুন করে এলে যাদু-মন্ত্র ও দলপতির মাধ্যমে দৈব বাণী। একেই বলি আমরা আদিম ধর্ম এবং তার আচরিত কথাসূত্রগুলিকে বলতে পারি আদি মহাজন বাক্য। ড. আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, ‘(আদিম) সমাজে যিনি ছিলেন বয়স্ক এবং অপেক্ষাকৃত বিচক্ষণ, বিভিন্ন যাদুবিদ্যার অধিকারী, তিনিই সাধারণত হতে দলপতি, তাঁর বাণী বা নির্দেশই ছিল আদিম প্রবাদ বাক্য। পরবর্তীকালে আর্যদের আগমনের পর যাকে বলা হয় জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষবিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা এবং পরিবেশবিদ্যা, যা তার চারপাশের দর্শনীয় বস্তু-তা নিয়েই  প্রবাদের প্রাচুর্য গড়ে উঠেছে। লিখিত উপকরণের অভাবে এই মৌখিক দৃষ্টান্ত, উপদেশ বা অনুকরণীয় বিষয়গুলি অতি সহজেই শ্রুতিধর ব্যক্তিদের মাধ্যমে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে এমনকি এক দেশ থেকে অন্য দেশেও পৌছেঁ যায়‍’।

সমাজপ্রিয় মানুষ উন্নত ও শক্তিধর সমাজের অনুকরণেও আসক্ত। তার সমাজ জিজ্ঞাসা ও আন্তসামাজিক কৌতুহল তাকে এই আচরণে লিপ্ত করে। আকাশ-সংস্কৃতির যুগে আজ মানুষ সমানাধিকারের চিন্তা করতে শিখেছে সেও এই ভাবেই। নারীবাদ, ধরিত্রী সম্মেলন, মানবাধিকার প্রভৃতি ধারণা ও কার্যক্রম যে প্রসারতা পেয়েছে তাও যে ক্রমেই প্রসারমাম হচ্ছে তার মূলেও সেই একই লোকজীবনের সত্যের তাড়না। ‘সিবোলেথের’ বাধা সত্ত্বেও অন্যে সংস্কৃতি জগতে আপনার কৌতুহল প্রবেশ সাধারণ-সেখানে সে আপনার অন্তর্সত্যকে যেমন প্রকটিত করতে চায় তেমনি অন্যের সত্যকূলকেও সে স্পর্শ করতে চায়। এ যেন সেই রবীন্দ্র বারতা- ‘দিবে আর নিবে মিলাবে আর মিলিবে, যাবেনা ফিরে’। ‘ভাষা’ যদিও সীমিত ‘কোড’, সংস্কৃতি সেক্ষেত্রে অনেক তরল ও প্রবাহমূলক ‘ফ্লুইড’ স্বরূপ। প্রবাদ, ধাধাঁ প্রভৃতি লোকসৃষ্টি এমন কি যা ‘লোকভাষা’ তারও বহু উপাদানকে তাই আমরা ভ্রমণশীল রূপে দেখতে পাই। অনুকূল ও প্রতিকূল সমাজ নির্বিশেষে ‘এক-সংস্বৃতি’ এলাকা (One Cultural Area) গড়ে ওঠে, যেভাবে গোটা ভারতবর্ষে ৪০০-এর অধিক ভাষা থাকা সত্ত্বেও ইমেন্যূ সাহেব তাঁর তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন যে, ‘India is a linguistic area’.

এভাবে একটা কথা যোগ করা আবশ্যক যে গ্রামীণ সংস্কৃতি যতটাই স্থানিক লোকসংস্কৃতি ততটাই অসংকীর্ণ ও বিস্তৃত। গ্রামজীবনের অনেক জিনিষ লোকসংস্কৃতির ধারক বা পরিচায়ক নয়, যেমন গ্রামেও আজকাল ‘বিউটি পারলার’ দেখা যাচ্ছে এবং পাল্কীর পরিবর্তে নতুন বর বধূ রিক্সায় শ্বশুরালয় বা পিত্রালয়ে যাচ্ছে। একইভাবে গ্রামীণ যে কোনও অনুষ্ঠানে সামাজিক হোক বা ব্যবসায়িক হোক তাতে সারাদিন-রাত মাইকে গান বাজানো হয় এবং সে সব গান সিনেমার গান, এমন কি হিন্দি গান ও। মানুষ গ্রামেও লোকস্বভাবের বিকৃতি ঘটাচ্ছে। এগুলি গ্রামের অবস্থাপন্ন মানুষদের প্রদর্শনী মনোভাব বা রুচির একটি দিক। গ্রামীণ ব্যাংকের কারণে গ্রামের দরিদ্র মানুষেরাও বিশেষত মহিলার মোবাইলে অহরহ প্রবাসী স্বামী বা পুত্রের সাথে কথা বলে। এসবই গ্রামীণ বাস্তবতা, কিন্তু লোক সংস্কৃতির সৃজনশীল কর্মের সঞ্চারণ রহিত।

অন্যদিকে শহুরে সংস্কৃতিতে লোকসংস্কৃতির অনাযাস বিস্তার বা প্রভাবও অগ্রামীণ, কিন্তু লোকজ। যথা বৈশাখী মেলা ব রমনার বটমূলে নববর্ষ উদযাপন এং স্বাধীনভাবে সৃষ্ট শহীদ দিবস, বিজয় মেলা, চিকামারা বা দেওয়াল লিখন, প্রভাতফেরী, মিছিল এমন কি গ্রন্থমেলাও। এখন আন্তর্জাতিকভাবে ‘কাবাডি খেলা’ ও অন্যান্য লোকজ খেলা (লাঠি খেলা ইত্যাদি) প্রভৃতির প্রদর্শণী হতে শুরু করেছে। সবগুলিতে লোকজ জীবনের পরিচয় শতভাগ না থাকুক এগুলিও যে আধুনিক প্রসারিত ধারণায় ফোকলোরের উপাদান সম্বলিত তা মানতেই হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে তা ‘পরম্পরাগত’ (ঐতিহ্যবাহিত) কিনা তা প্রমাণ সাপেক্ষ হতে পারে, কিন্তু পরম্পরাভাবই ফোকলোরে মৌল বিষয় নয়, লোক গ্রাহ্যতাই তার মূল পরিচয়কে সনাক্ত করে। তাই কখনও যদি গ্রামে মোবাইল ব্যবহার, মাইকিং (ওয়াজ মাহফিল বা জানাজার সময় ঘোষণীয় ইত্যাদি) ইত্যাদিতে লোকরূপ লক্ষ্য করা যায় এবং লোকজ শৈল্পিকতা বা সৃজনশীলতার রূপ প্রকাশ পায় তখন তা ‘ফোকলোর’ বা লোকসংস্কৃতির রূপেই গ্রহীত হবে তা যত আধুনিক হোক। লোক সংস্কৃতির উপাদান সমভূমিতেও যা, দ্বীপাঞ্চল বা পার্বত্য এলাকাতেও তাই। যা ফোকলোর তার ভিন্নতা নেই কোথাও, স্থানভেদে তার বৈচিত্র্য ঘটতে পারে মাত্র। কিন্তু তর ‘উপাদন’ সর্বত্র সমরূপী। সাধারণ বা লোক মনুষের স্বভাবের জন্যই তার এই সমরূপিতা বা সমমৃদ্ধিতা এবং বৈচিত্র্যও। যেমন, প্রাক ইসলামী যুগে আরববাসীরা কবিতা ভালবাসতো, হাটেবাজারে গিয়ে একজন কবিতা পড়ে শোনাতো, লোকেও তা শুনতে পছন্দ করতো। প্রাচীন কা’বার মেলায় ইমরুল কায়েসের কবিতা বিনোদনের অন্যতম বিষয় ছিল। ভারত উপমহাদেশে আজ যে মুখায়রা হয়, সেটা তারই স্থানীয় রূপ মাত্র। ভূত প্রেত ডাইনী নিয়েও বিভিন্ন দেশের ধারণার সমিলতা আমাদের এইভাবে অবাক করে। আমাদের দেশে বাচ্চাদেরকে জুজু-র ভয় দেখানো হয়। এই ‘জুজু’র উৎপত্তি ও তার বিভিন্ন ধরণ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন ‘লোককৃতি কথাগুচ্ছে’র গ্রন্থাকার লোক ও শিশু সাহিত্য গবেষক আতোয়ার রহমান। ‘পরী’ এবং সমরূপী অন্যান্য জীব নিয়েও অনেক তথ্য উপস্থিত করেছেন তিনি। ধারণাগুলি আদি লোকজীবনের নানা রহস্যগুণাত্মক।

এইবার পার্বত্য ও সমভূমিজ প্রবাদের কথায় আসি। আমি অন্যত্র বলেছি বাংলাভাষার ‘প্রবাদ’ এক সময় ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতো। যেমন, প্রবাদ আছে মানুষ অপকর্ম করে মারা গেলে বা অতৃপ্ত আশা রেখে অপমৃত্যু ঘটলে তার আত্মা গাছে বেতালের মত ঝুলে থাকে। অর্থাৎ জনশ্রুতি, সুভাষণ, মহাজন উক্তি, মিনতি শিলুক প্রভৃতি অর্থে বা ভাবার্থে ‘প্রবাদ’ -এর ব্যবহার ছিল। লঙম্যান চৎড়াবৎন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন উইলিয়াম মর্টন বা নীলরত্ন হালদার প্রমূখ তাঁর পূর্বসুরীরা ‘কবিতারত্ন’, ‘দৃষ্টান্ত বাক্য’ প্রভৃতি শব্দ বা পরিভাষা ব্যবহৃত করেছেন। (দ্রষ্টব্য মৎ প্রণীত ‘লোকসাহিত্যের ভিতর ও বাহির’ দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০২: পৃষ্ঠা. ১০১-১০৩) ইংরেজী শব্দের সাথে ধ্বনিগত সাদৃশ্য থাকায় তিনি ‘প্রবদা’ কথাটি ব্যবহার করেন এবং এই অর্থেই শব্দটি প্রচলিত হয়ে অভিধানেও স্থান পায়। প্রবাদের বৈশিষ্ট্য বা গুণ তার চিরত্ব, শব্দ প্রকৃতির বৈচিত্র্য (বাঘ/বাঘা; জুতা/জুতুয়া ই:) ও যদৃচ্ছাকৃত বাক্যরূপ।

এই ধরণের প্রবাদের কথা আমি আমার পার্বত্য এলাকার বন্ধু ছাত্রদের মুখে বিশেষ শুনতে পাই নি। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সভাপতি থাকা কালে ছাত্রদের নিয়ে মনিকছড়িতে (খাগড়াছড়ি) ফিল্ড ওয়ার্ক করার সময়ও তেমন তথ্য লাভ করতে পারিনি। ১৯৮০-০৩ ড. দুলাল চৌধুরী ‘চাকমা প্রবাদ’ প্রকাশ করেন। কিন্তু সংকলনটি মিশ্র বলেই আমার ধারণা। তাছাড়া গ্রন্থটি প্রচারও লাভ করেনি তেমন। এই সব কারণে বর্তমান উদ্যোগতে আমি মনোযোগী হই। এক্ষেত্রে আমার সহায়ক হল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কৃতি ছাত্র শ্রীমান কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা। তার এবং তার বন্ধুদের সংগ্রহ থেকে তঞ্চঙ্গ্যা তথা পার্বত্য এলাকার প্রবাদের মধ্যে নিম্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করতে পারি-

১. গঠন ও ভাবগত দিক থেকে চাকমা প্রবাদের সাথে এর অনেকাংশে মিল বিদ্যমান, যদিও তঞ্চঙ্গ্যা গঠনে কিছুটা তীব্রতা ও প্রাচীনতাও লক্ষ্য করা যায় যা চাকমার ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। যেমন, ‘সর্গ (স্বর্গ) গু খাই দিককনে’? বা ‘সাপপয়া উলে পুদাই-দ, ব্যাঙয়া উলে ফালাই-দ’ ইত্যাদি।

২. বাংলা ভাষার (চট্টগ্রামসহ) সাথেও এর মিল দূরাগত নয়, যথা-

ক. ‘পেলায় পেলায় বাজ্জাবাড়ি খান’

(বাংলায়= ‘পাতিলে পাতিলে ঠোক্কর লাগেই’)

খ. ‘পয়ায় ন কানিলে দুধ খায় ন পান/ পায়’

(বাংলায়= ‘পুতে না কান্দলে মাও দুধ দেয় না’)

গ. ‘মুয়ত জয় মুয়ত খয় (ক্ষয়)’

বাংলায়= ‘যেই মুহে (মুখে) জয় হেই মুহেঐ (মুখেই) ক্ষয় অয়”)

ঘ. ‘পেদৎ বোক মুয়ত লাইত’

(ঢাকা= ‘পেডে ভূখ থুইয়া মুহে শরম’

(চট্টগ্রাম= “প্যেডৎ বোক মুগোৎ/ মুয়ৎ লাজ”)

ঙ. ‘এক্কয়া শিলৎ এক্কয়া কাঁড়া’

(বাংলায়= “নানা মুনির নানা মত/ যার ঘরে সে রাজা”)

৩. কিছু কিছু প্রবাদে ভাবগত মিলটা খুবই সাধারণ ও নৈকট্যসূচক-

ক. ‘খাং খাং মাইনসত্তুন গেয়াহ্ নাই,

দাং দাং মাইনসত্তুন বউত্ নাই’

(বাংলা= “অতি গেরস্থ না পায় ঘর, অতি ঘরণী ন পায় বর”)

এখানে তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদটির আক্ষরিক অর্থ হল- ‘খাই-খাই মানুষর শরীর থাকেনা, পালাই-পালাই মানুষের কোন বস্তুই থাকেনা’। ইংরেজীতে সম্ভবত এটাকেই বলে- ‘rolling stone, gathers no moss,’। এর সমার্থকতার বাংলা প্রবাদটি ভিন্ন গঠনের, যথা- ‘যে রহে সে সহে’। কিংবা ‘যে চলে সে রহে’।

৪. তঞ্চঙ্গ্যা প্রবাদ এক বাক্যিক গঠন, দ্বিচরণিক গঠন, ছড়ার গঠন ছাড়ও কখনও কখনও সদর্থক বাক্য ও নঞর্থক বাক্য মিলেও একটি রূপ পায়, যথা- ‘যে গাছৎ উদি জানে তারে টেলি ন দিলেও উদি পারে, আর যে ন পারে তরে ঠেলি দিলেও ন পারে’।

এই সব প্রবাদ- উক্তিতে ভাষার বৈচিত্র ও ভিন্নতা থাকলেও সাংস্কৃতিক অবিচ্ছেদ্যতাই প্রমাণিত হয়।

৫. ‘ছায়-ল কানত্ (কান) মন্ত্র বড়ায় দেনা’।

(বাংলা= ‘কথায় কান না দেওয়া’)

৬. ‘নরম পালে উ-ম কুরাও পুদান’

(বাংলায়= ‘নরম বা দুর্বলকে সবাই ঠকাতে চায়’)

৭. ‘এক্কয়া কুউরে (কুকুর) ভাত খালে আর এক্কয়া কুউরে চাই থাই ন পারে’

(বাংলা= ‘একজনের সুখ অন্য জন সহ্য করতে পারে না’)

৮. ‘মরা বাই-স (বাঁশ) সমারে জেদা (জীবিত) বাই-স পুরি যান’

(বাংলা= ‘দোষীর সাথে নির্দোষীরাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়’

৯. ‘আদে দুরি দুখ টা (আ) না’

(বাংলা= ‘জেনে শুনে কষ্ট/দুঃখ পাওয়া’)

১০. ‘আওই ন কুড়ে ঘি গনানা’

(বাংলা= নারীর সংস্পর্শে পুরুষের মন নরম হওয়া’)

১১. ‘আই-স (হাতি) পুনত কুউরে ভুয়ানা’

(বাংলা= (শক্তিধরের কাছে দুর্বলের নিষ্ফল আকুতি)

১২. ‘আউইনত্ (আগুন) পানি দেনা’

(বাংলা= চরম সমস্যার সমাধান করা)

১৩. ‘আক্কল বাধি অনা’

(বাংলা= স্বল্পবুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া)

১৪. ‘আলু কুইল্যে গাত্তয়া (গর্ত) থাই’

(বাংলা= ঘটনা ঘটলে প্রমাণও থাকে)

১৫. ‘ইচা শুউনি (শুটকি) অনা’

(বাংলা= মিশুক হওয়া)

১৬. ‘ইহিম কামত্ ফল পানা’

(বাংলা= মনোযোগের কাজে সুফল পাওয়া)

১৭. ‘ইচা (চিংড়ি) কবালত্ গু’

(বাংলা= ‘অতি চালাকির বোকামি প্রকাশ)

১৮. ‘উসুনা কুড়ায় ডাক কারানা’

(বাংলা= অসম্ভব ব্যাপার)

১৯. ‘কুড়া (মুরগী) লাইত’

(বাংলা= প্রথম অবস্থায় লজ্জা পাওয়া)

২০. ‘চিল দরে কুড়া ছ ন পুছানা’

(বাংলা= ক্ষতির আশঙ্কায় ভাল কাজ না করা)

২১. ‘সিনডালে ও লো (রক্ত) ন নিগানা’

(বাংলা= অতি কৃপনতা)

২২. ‘মুঅ গুনে ব্যাঙ ময়ে/মরে’

(বাংলা= নিজের দোষে নিজের বিপদ ডেকে আনা)

২৩. ‘ঠেঙ (অ) কোইত্ উরি দেনা’

(বাংলা= অসৌজজন্যতা)

২৪. ‘দ্বি-জন ছেড়ে ছুমানা’

(বাংলা= সুসম্পর্কের ফাটল ধরিয়ে দেওয়া)

২৫. ‘পাইত্তে পাইত্তে রাইত্তে পাইত্’

(বাংলা= কান কাজ করতে করতে অভ্যাস হওয়া)

২৬. ‘বিচ্যা গরুর দাঁত চাইনে লাভ নাই’

(বাংলা= গৃহিত সিদ্ধান্তের পরে পর্যালোচনা নিষ্প্রয়োজন)

২৭. ‘গুইত্তুন মু্ত্ গম অনা’

(বাংলা= আগে খারাপ থেকে বর্তমানে এসে ভালো সাজা)

২৮. ‘ঘ-র উন্দুরে বেড়া কামারান’

(বাংলা= ঘরের শত্রু দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া)

২৯. ‘রাঙা কালা মু অনা’

(বাংলা= কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া)

৩০. ‘ভুত্তোয়া কুউরে/কুগে রোঙ কারা-না’

(বাংলা= খালি কলসি বাজে বেশি)

৩১. ‘গরু-ছাঅল ডরে ক্ষেত গিরাদি রাখানা/রাগানা’

(বাংলা= নিজের সম্পদ নিজে যত্ন নেওয়া)

৩২. ‘আইডে আইডে ধদাডোদি/দলাডুলি টিক্ষ্যা (নলখাগড়া) কা(অ)রা গুরি’

(বাংলা= দুই পক্ষ সবলের শক্তি প্রদর্শনের ফলে দুর্বলের ক্ষতি হওয়া)

৩৩. ‘দা-শি দিলে নাচি খায়, সবা-ইত ন পালে মা-ই খাই’

(বাংলা= প্রথমে দিলে খাই না পরে নিজে খুজেঁ খাই)

Toingang
Toingang
Articles: 55

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *