রাধামন-ধনপদি পালাঃ প্রেম এবং প্রকৃতি

কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা

ভূমিকাঃ

রাধামন ধনপদির পালাতে ব্যক্তির প্রনয়-বিরহ এর পাশাপাশি সমন্ধয় ঘটেছে দেশপ্রেম, প্রকৃতি এবং ইতিহাসের। আমরা লক্ষ্য করি যে, বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য একই উপাদনে সংমিশ্রণ রয়েছে এই সৃষ্টি কর্মে। তঞ্চঙ্গ্যা ও চাকমা পৌরানিক ইতিহাসে বেশ কিছু পালা (উপাখ্যান) আছে। যে উপখ্যানগুলি দেশ,কাল, সামাজিক জীবন, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে আশ্রয় করে রচিত হয়েছে। এই উপখ্যানগুলির রচয়িতাদের সুনির্দিষ্ট করা না গেলেও এর কাহিনী এবং বিষয়বস্তু কালে কালে ছুয়ে গেছে দেশ,কাল,জাতি ও সমাজকে। বিশেষ করে গেঙগুলীদের কন্ঠে বেহেলার সুরে এই পালাগুলি যখন পরিবেশিত হয় তখন ব্যক্তি আর তার মধ্যে থাকে না সে ফিরে যায় শত বছর আগে আপন জনের ফেলে আসা স্মৃতির মধ্যে। চাদিগাঙ, জুম কাবা, রান্যা বেড়া, ফুল পারা ও রাধামন-ধনপদি পালাগুলি হচ্ছে অন্যতম। আমরা ইতিহাসে দেখি রাজা বিজয়গিরির সেনাপতি হচ্ছেন রাধামন আর রাধামনের সহধর্মিনী হচ্ছেন ধনপদি। 

রাধামন-ধনপদি পালা পৌরানিক সাহিত্য ইতিহাসে তেমনি একটি ঐতিহাসিক প্রনয়োখ্যান। উক্ত উপাখ্যানে তারা নায়ক-নায়িকা, পরবর্তীতে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমরা দেখতে পাই। রাধামন এখানে বীর যোদ্ধা, সেনাপতি, বলবান, বীর্যবান, রূপবান এবং আর্দশবান একজন পতি। স্ত্রীর আকুল ভালোসাকেও যত্নে পাশে রেখে দেন,স্বযত্নে মাতৃভূমিকে রক্ষা এবং বিপদে প্রতিবেশী বা বন্ধুকে সাহায্য করাই যেন তার ব্রত নিয়ে। আর ধনপতি পতিভুক্তি একজন সতী  নারী, যেখানে স্বামীর মঙ্গলই তার একমাত্র কামনা। তারা চম্পক নগরের নরপতি সাদেংগিরির কন্যাদ্বয় মেনকা এবং কপতি’র পুত্র এবং কন্যা সন্তান। মেনকার-জয়মঙ্গলের গর্ভে জন্ম নিল রাধামন আর কপতি-নিলগিরির গর্ভে জন্ম নিল ধনপতি। রাধামন এবং ধনপতির শৈশব কৈশোর কেটেছে হেলেদুলে হাসি আনন্দে, রাঙাপুতুল খেলে, সুশীতল স্নীন্ধ ঘন ছায়াতল। জুমের ফুলপথে ঘুরে ফিরে আর দল বেঁধে জুম ঘরে বসে হাসি খেলে দিনগুলি অতিবাহিত হতো। তারা যুবক যুবতীরা মিলে জুমে নানা তরকারী খুজঁতে যেতো। বিষু দিন হলেতো কথাই নেই। পাইসনের জন্য যুবক-যুবতীরা দল বেধেঁ জুমে যেত তরকারী খুজঁতে। জুম থেকে নিয়ে আসতো মা শমোই, কুরাঙা শমই,মারফা, জুম্ম্যা বেগুন, জুম কুমড়াসহ নানা তরকারী। আর বাড়িতে ফিরার সময় নিয়ে আসতো জু-ম ফুলের গাছ। তারা এসে এটি রোপন করতো ছড়ার কোন বড় মরঙের (প্রকৃতি সৃষ্ট বড় কোয়া) পাশে। আর প্রার্থনা করতো তারা যেমন জীবন এইভাবে হেসেখেলে সুখে শান্তিতে থাকতে পারে। আর সাথে ছিল সবুজ গাছের সারি ও জঙ্গল আর নানা রকম ফল-ফলালি, পাখির কলকাকলী এবং আকাশে সাদা মেঘের ভেলা । 

রাধামন এবং ধনপদির যৌবনের প্রথম বসন্ত কেটেছে সৌরভিত ফুল বনে। তাদের প্রেম-ভালোবাসা দেখে বসুন্ধরা হেসে উঠে আপন মনে। বসন্তের কোকিলও গেয়ে উঠেছে গান আপন মনে। ফাগুনের নব হিলোলে তাদের প্রাণে জাগে নব শিহরণ। ধনপতি শুরু থেকে নানাভাবে রাধামনকে ভালোবাসার কথা জানান দিলেও রাধামন ধনপতির ভালোবাসাকে সেভাবে গ্রহন করতে চাইনি প্রকৃতির নিয়মে। সে রাধামনকে পাওয়ার জন্য কুমারী বয়সে শ্রীবুদ্ধ চরণে পূজা দিবে মানস করে রেখেছে। ধনপদি রাধামনকে যখন তার ভালোবাসার কথা জানায় তখন প্রকৃতিও যেন খুশীতে ভরে উঠেছে তবু রাধামন বিনয়ের সাথে বলেছে সমাজের নানা বাধাঁধরা নিয়ম আছে। রাধামনের কথা শুনে ধনপতি বলেছেন- আমি মানিনা এইসব বাধাঁধরা নিয়ম কানুন। তিনি রাধামনকে মিনতি করে বলেছেন- 

                “তব পায়ে এ মিনতি মম, 

                  আশা তুমি করহে পূরণ, 

                  দাসী হয়ে চিরদিন সেবিব জীবনে তব দু’চরণ”। 

ধনপদি- চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারাদের ধর্ম সাক্ষী রেখে আরো বলে- 

                 ‘তুমি বিনে পতি নাই নিজে আমিত্য জীব জীবন, 

                  তোমায় চরণ বিনে কিছুই নাই মম’। 

ধনপদির কথা শুনে রাধামনের মন গলে যায়। তখন রাধামন বলে- 

                 ‘ধর্ম সাক্ষী করে আজ হতে তুমি মম ধর্ম পত্নী হলে,

                  মানবের সত্যধর্ম বিনা নাই কিছু এই মহীতলে, 

                  সত্যের মহিমা সতী নারী নাম ভবে রবে চিরদিন”। 

শেষ পর্যন্ত রাধামন ধনপদির পবিত্র প্রেমে সাড়া দিতে বাধ্য হয়। এরপর তারা প্রেমের সাগরে ভাসতে থাকে। একে অপরকে দাদা এবং বোন হিসেবে সম্বোধন করলেও রাধামন আদর করে ধনপদিকে ডাকেন ‘প্রাণেশ্বরী, ওগো সতি, সুব দনি’ হিসেবে আর ধনপদি স্বামীকে আদর করে ডাকে ‘প্রাণ নাথ, প্রাণেশ্বর’ হিসেবে। সে স্বামীকে খুব বেশী ভালোবাসে এবং স্বামীর মঙ্গল কামনা করে শয়নে স্বপনে সাথে স্বামীর আপদে বিপদে সবসময় মঙ্গল কামনা করেছে। 

এই ভালোবাসার দাবী নিয়ে ধনপদি মাঝে মধ্যে রাধামন কাছে নানা কিছু আবদার করে বসত। সেরকম একদিন ধনপদি নদীতে গোসল করতে গিয়ে দেখল সুন্দর একটি ফুল নদীর পানিতে ভেসে আসছে। সে ফুলের গন্ধ কি মনোরম। এই পর্যন্ত যতগুলো ফুল সে দেখেছে এবং গন্ধ নিয়েছে এই ফুলটির কাছাকাছি কোনটি নয়। ফুলটি তুলে নিয়ে তার মাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল- মা এটি কিসের ফুল। মা বলল এটি ‘দেব নাগেশ্বর ফুল’। ধনপতি আরো জিজ্ঞেস করল এই ফুল কোথায় পাওয়া যায় ? মা বলল- উজানে গাঙে ইরাবতী নদীর (এটি মায়ানমারের একটি নদী) তীরে শৈলগিরি কাননে এই ফুল ফোটে। মা আরো বলল- অলি মধু খেয়ে এই ফুল নদীতে ফেলে দিয়েছে। ধনপদি তখন মনে মনে ভাবতে থাকল সদ্য ফোটা এই ফুল যে কি সুন্দর হবে। তখন তার মনে বাসনা জাগে সদ্য ফোটা এই দেব নাগেশ্বর ফুলটি একদিন দেখবে এবং দাদা রাধামনকে সে তার মনের বাসনা কথা জানাবে। একদিন বাসন্তী পূর্ণিমার শুভ্র রাতে সে তার মনের কথা রাধামনকে বলছে, ধনপতি ঘুমের মধ্যে এই স্বপ্নগুলি দেখছে। একটু একটু শীতল আমেজতা আলোর ছলকানি হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখে দিনমনি পূর্বাকাশে জ্বল জ্বল করে উঠেছে। 

বছর শেষ বাসন্তী পূর্ণিমা তিথি। ধনপতি ঠিক করল বাসন্তী পূর্ণিমা রাতে রাধামনকে তার বাসনার কথা জানিয়ে দেবে। এই বাসন্তী উৎসবে সবাই নিজের মতো করে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে যুবক-যুবতীরা ঘিলা খেলা, নাদেং খেলা নিয়ে। সেসময় রাধামন-ধনপতির মতো প্রেমিক যুগল; কুঞ্জবী-কুঞ্জুধন, নিলংবী-নিলংধন, মেয়াবী-মেয়াধন, কানেকবী-কানেকধন সবাই মিলে ঘিলা খেলা খেলবে বলে ঠিক করল। বাসন্তী পূর্ণিমা রাতে রাধামন আর ধনপদি দেব নাগেশ্বর ফুল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইরাবতী নদীতে চলে যায়। তারা বনে গিয়ে দেখে অতি উচ্চ ডালে এই ফুলগুলি ফুটে আছে। সে মনে মনে ভাবে এই ফুল নিতে হলে অবশ্যই বৃক্ষ দেবতার আর্শীবাদ লাগবে। এই দিকে রাধামন যখন দেব নাগেশ্বর ফুল নেওয়ার জন্য লতাগুলিকে বাশেঁর মতো করে বেঁধে তৈরী করতে লাগল তখন ধনপদি বলল যে, আমি এই অন্ধকারে কিভাবে নিচে একা থাকব। তাছাড়া তখন এই ইরাবতী নদীর বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে বন্য হাতি, ভলুক, বাঘ, নেকড়ে আরো অনেক বন্যপ্রাণী। ধনপদির বিপদের কথা ভেবে রাধামন জলের উপর এটা জলটংগি মাচাং তৈরী করে দেয় এবং ধনপতিকে নিজের কাঁধেতুলে সে জলটংগীতে তুলে দেয়। যেন ধনপতি নির্ভয়ে থাকতে পারে। সে যখন ফুলের জন্য বৃক্ষ শাখায় উঠে হঠাৎ আগে দেখা ফুলগুলি অদৃশ্য হয়ে গেল, দুরের শাখায় মাত্র একজোড়া ফুল দেখা যাচ্ছে। রাধামন বুঝতে পারে বৃক্ষ দেবতা ফুলগুলি অদৃশ্য করে রেখেছে। পরক্ষণে রাধামন লক্ষ্য করেছে বৃক্ষ দেবতা তাকে বাঘের ছায়া হয়ে ভয় দেখাচ্ছে। এতে রাধামন ভয় পেয়ে গাছ থেকে ভূতলে পড়ে গিয়ে মূর্ছা গেল। ধনপতি হঠাৎ লক্ষ্য করল কি যেন একটা নিচে পড়ে গেল এবং শব্দ হল। চেয়ে দেখল রাধামন নিচে পড়ে গিয়ে মূর্ছা যায়। মূর্ছা পাওয়া রাধামনকে ধনপতি কোলে তুলে নিয়ে খাদির আচল দিয়ে মুখ মুছে দেয় এবং রাধামনকে ডাকতে থোকে প্রাণেশ্বর, প্রাণেশ্বর বলে। রাধামনের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ধনপতি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শোকাকুল হয়ে ইষ্ট দেবতাকে স্বরণ করে বলে- প্রভু দাও হে আমায় কুল। তখনও বৃক্ষ দেবতা নানাভাবে ধনপতিকে ভয় দেখাচ্ছে। মাঝে মধ্যে বাঘের গর্জনে, মাঝে কালান্তর সাপ হয়ে, আর মাঝে মধ্যে বৃহৎ হস্তি রূপে ধনপতিকে বৃক্ষ দেবতা ভয় দেখাচ্ছে। এদিকে ধনপতির আকুল ক্রন্দনে এবং শোকে দেহ মন হয়ে গেছে মলিন কারণ তার জীবনের সাথী পড়ে আছে অচেতন হয়ে। তবু এ ঘোর বিপদে ধনপতি ভগবানকে ডাকে বারে বারে। ধনপতি বলে আমি যদি সতী নারী হয়ে থাকি তাহলে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দাও। ধনপতি কথা শুনে বৃক্ষ দেবতা হাজির হয়ে সঞ্জিবনী মন্ত্র পাঠ করে রাধামন আগের অবস্থায় ফিরে আসে। সে সুস্থ হয়ে দেখে ধনপতি কোলে তার মাথা। তখন রাধামন শুনতে পেল- আকাশ ও ভূমি বাসীদেব নাগ যক্ষ মহা ঋদ্ধি মান,রক্ষে সদা সতী নারী ধার্মিক সুজন পূন্যবান। 

প্রেম-ভালোবাসা আর রাগ-অনুরাগের এবং মান-অভিমানের মধ্যে দিয়ে রাধামন ধনপদির ভালোবাসা পূন্যতা পায় তাদের শুভ পরিনয়ের মধ্য দিয়ে। রাধামন ধনপদির বিয়ের সমস্ত কিছু আয়োজন করল রাজ পুরোহিত ছলারবাপ। যিনি রাজ দরবারে শুভ-অশুভ, মঙ্গল-অমঙ্গল এবং নানাবিধ পূজা-আর্চনা করে থাকেন। রাধামন-ধনপতি যাকে দাদু বলে সম্বোধন করেন। ছলারবাপও তাদের নাতি-নাতনি বলে যথেষ্ট আদর স্নেহ করেন। একদিন রাধামন-ধনপদি ছলারবাপের কাছে গিয়ে বলে দাদু আমাদের বিয়ের চুমুলাঙ আপনাকে করে দিতে হবে। ছলারবাপ তখন বলে, দাদু-দিদি ভাই আমি বুড়ো মানুষ কিভাবে আমি তোমাদের চুমুলাঙ করে দিব আমিতো হাটতে তেমন পারি না। রাধামন-ধনপদি তবু ছলারবাপকে অনুরোধ করতে লাগল- তাদের বিয়ের চুমুলাঙ করে দিতে। অনেক অনুরোধের পর ছলারবাপ রাজী হয়ে গেল। তখন রাধামন-ধনপদি বলল, দাদু তাহলে তুমি আমাদের বিবাহ জীবন কেমন হবে রাত্রে নিশাদেবীকে স্বরণে বিজ্ঞেস করবে। ছলারবাপ বলল ঠিক আছে। পরদিন ছলারবাপ রাধামন ধনপদির বিয়ের চুমুলাঙ করে দিল। এখানে একটি বিষয় উলে­খ্য যে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে এখনো বিয়ের পর চুমুলাঙ করে নতুন বউকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে ঘরে তোলার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। বিয়ের চুমুলাঙ করে দেওয়ার পর ছলারবাপ তাদের মন ভরে আর্শীবাদ করল এবং বলল আর্শীবাদ করছি- তোমাদের দাম্পত্য জীবন মঙ্গলময়, সুখময় এবং মধুর হউক। তোমরা নিরাময় র্দীঘ জীবন এবং তোমাদের যথা ইচ্ছা পূর্ণ হউক আর তোমাদের ঘরে লাল টুকটুকে এক বীর সন্তান আসুক। চুমুলাঙ শেষে রাধামন তার দাদুকে জিজ্ঞেস করল দাদু রাত্রে তুমি নিশাদেবী দর্শন করে কি দেখলে ? তখন ছলারবাপ বলল, না অমঙ্গল কিছুই দেখিনি, তবে। তবে মানে কি দাদু রাধামন জিজ্ঞেস করল। তাহলে মন দিয়ে শুন দাদা-দিদি আমার স্বপ্নের বিবরণ। আমি গতরাত্রে নিশাদেবী স্বরণ করে ঘুমিয়ে পড়ি, প্রথম প্রহরে স্বপ্ন দেখলাম- আমি চৌদ্দ ডিঙা সেজে নানাবিধ পন্যদ্রব্য নিয়ে উজান গাঙে পাল তোলে চলেছি। অনেকদুর এগিয়ে নানা ফুল-ফল ও পশু-পক্ষী পরিপূর্ণ এক সুবিশাল ছায়াশীতল বটবৃক্ষে নিচে বিশ্রাম করেতেছি। এমন সময় ঘুম ভেঙে যায়। তারপর দাদু কি হলো উভয়ে প্রশ্ন করলো। তারপর ছলারবাপ বলল- আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ে নিশাদেবী স্বপ্ন দর্শন দেওয়ার অনুরোধ করলে তখন দেখলাম- পূর্ব দিকে উঠেছে এক ধুমকেতু নক্ষত্র তারা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে দেখি পূর্ব গগনে সূর্য উঠেছে। স্বপ্নের অর্থ কি হবে জিজ্ঞেস করলে ছলারবাপ বলল- উজান গাঙে অর্থ হচ্ছে- তোমাদের দাম্পত্য জীবন উজান দিকে চলবে মানে সুখের হবে। ছায়া শীতল বট বৃক্ষ অর্থ হচ্ছে তোমাদের একটা সুপুত্র জন্মাবে বৃদ্ধ বয়সে সেই পুত্রের আশ্রয়ে সুখে শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে। আর দ্বিতীয় স্বপ্ন পূর্ব দিকে যে ধুমুকেতৃ তারা দেখেছিলাম তার অর্থ হচ্ছে- একসময় দেশে যুদ্ধের ধামাকা বেজে উঠবে। তারপর রাধামন প্রশ্ন করে তাই যদি হয় দাদু তাহলে কি আমায় যুদ্ধে যেতে হবে ? তার দাদু বলল- দেশে যদি যুদ্ধের ডাক এসে যায় তাহলে কি তুমি নীরব থাকতে পারবে ? এভাবে সুখ দুঃখের স্বপ্ন দর্শন নিয়ে তারা সংসার শুরু করতে লাগল। এখানে একটি বিষয় উলেখ্য যে, তন্চংগ্যা সমাজে অনেকে তাদের শুভ কাজ শুরু করার আগে এরকম শুভ-অশুভ স্বপ্ন দর্শন চাওয়া হয়। 

একদিন রাজ সভা থেকে খবর এল যুদ্ধে যেতে হবে। পার্শ্ববর্তী রাজা উদয়রাজ তার রাজ্যে পূর্ব দিকের জংলী কুকীরাজ কালাঞ্জয়, দক্ষিণ দিকের রোয়াঙ্গের মঙ্গলরাজা আর সমুদ্র কুলের জল দস্যুরা দিবালোকে এসে নরহত্যা নারী নির্যাতন করছে। আজ তার রাজ্যবাসীরা গৃহহারা। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মিত্র চম্পক রাজার (উদয় গিরি) থেকে সাহায্য চেয়েছেন। এখানে একটি বিষয় উলেখ্য যে, এরই মধ্যে রাধামন যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে যুবরাজ বিজয়গিরির সেনাপতি হিসেবে যোগদান করেছেন। একদিন বিজয়গিরি রাধামনকে ডেকে বলল- শুন, প্রিয়সখা- উদয়পুর রাজ্য আজ দস্যু কবলিত, পিতা আমাকে সেখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে, তুমিও যাবে আমার সাথে সেনাপতি হিসেবে। প্রতি উত্তরে রাধামন বলল- যুবরাজ, তুমি মম সখা, তুমি যা আদেশ করবে আমি তা পালন করতে বাধ্য। তিনি আরো বললেন- বীরধর্ম্মো হলো বিপনকে প্রাণপনে রক্ষা করতে হবে যুদ্ধ করে। এইদিকে যুদ্ধের কথা শুনে ধনপদির মন অস্থির এবং চঞ্চল হয়ে উঠল, তবু সে কিন্তু তার স্বামীকে যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল না। এখানে দেশপ্রেম এবং পতিভক্ত সমতালে। তবু স্বামী বলে কথা, এই চিন্তা থেকে সে গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে,বলে- 

“শুন ওগো স্বামী ! গভীর নিশীতে দেখেছি স্বপন,

অতীব ভীষণ- কাঁপে ভয়ে মম প্রাণ,

সে স্বপ্ন স্মরি। ভাগ্যে মোর কিবা আছে জানি না।”

রাধামন বলল কি স্বপ্ন দেখেছ তুমি আমাকে খুলে বলো না, কি ভীষণ স্বপ্ন করিলে দর্শন কেন ভয় পেলে মনে। ধনপতি বলল তাহলে শুন মোর প্রাণনাথ !

“গেরিয়া স্বপন ভীত মম প্রাণ, রহে যেন প্রলয় পবন,

কাপায়ে ধরণীতল,কক্ষচ্যুত তারকা মন্ডল, 

রাজদন্ড উড়ে মহাশূন্যে, তুমি নাই পাশে মম, 

তাই একাকিনী আমি, চেয়ে থাকি শূন্য পানে, বসে একা শূণ্য ঘরে।”

ধনপদি আরো বলে স্বপ্ন দেখে রাত্রে আমার ঘুম ভেঙে গেল তখন শুনলাম- নানা পশু-পাখি ডাকিতেছে। পাখি ভীমরাজ ডাকছে গগন বিদারী করুন স্বরে। আরো শুনলাম টিয়া পাখি ঝাক উড়ে যাচ্ছে, বিকট শব্দে বানর-বানরী ডাকছে, স্বশব্দে পালিয়ে যায় হরিণ-হরিণী। ঘুঘু ডাকছে আম ডালে বসে। এমন নিশীথ রাতে পশু-পক্ষী দিশেহারা হয়ে কেন আর্তনাদ করছে। জিজ্ঞেস করে ধনপদি তার স্বামী রাধামন থেকে। রাধামন বলে দুর কর মনের গতি। রাধামন বলে ত্রেতা যুগে সীতাকে উদ্ধারের জন্য রাবন এবং রামের মধ্যে যখন যুদ্ধ হয় আর দ্বাপর যুগে কুরু ও পান্ডবে যখন যুদ্ধ হয় তখনও নিশীথে লোকে পশু-পক্ষীর ডাক শুনেছে। কই তখনতো কোন অধর্মের জয় হয়নি, ন্যায় ধর্মের এবং সত্যের জয় হয়েছে। তুমি জেনে রাখো কোন অমঙ্গল হবে না আমাদের। বীরের রমনী তুমি, হাসি-মুখে আমাকে বিদায় দিতে হবে তোমাকে। তুমি মনে রাখবে সতীর পতি হয় না পরাজয় কখনো। রাধামন আরো বলে কোন চিন্তা তুমি করো না দেব ধর্ম থাকিবে সহায় আমাদের সাথে। সত্য যদি হয় তুমি সতী নারী তাহলে শক্রর সাথে রণে আমি অবশ্যই জয়ী হবো। ধনপদি বললো- তুমি অবশ্যই যুদ্ধে জয়ী হবে, আমি এই প্রার্থনা করি শ্রী ভগবান বুদ্ধের কাছে। ধনপদি আরো বলল-তুমি যেদিন জয়ী হয়ে ফিরবে সেদিন দুজনে মিলে বুদ্ধের চরণ তলে পূজা দেব, তা আমি মানস করে রাখবো। ধনপদি স্বামীকে বলে- মিনতি তোমার চরণে তুমি দিগি¦জয় হয়ে ফিরে আসবে, আমি তৃষিত হরিণীর মতো তোমার পথের পানে চেয়ে থাকব। রাধামন বলে প্রাণেশ্বরী তুমি চিন্তা করো না- রণে স্থলে সর্ব ক্ষেত্রে তোমার চাঁদ মুখখানি আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকবে। 

রাধামন একদিকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আর অন্যদিকে ধনপদির মন চঞ্চল হয়ে উঠছে তার স্বামীর জন্য। স্বামীর মঙ্গল কামনার জন্য তার কত না মানস, কত না নানা আয়োজন। তারই অংশ হিসেবে- সে তার স্বামীকে যুদ্ধে যাত্রার আগে সতীত্ব নির্দশন হিসেবে নিজ হাতে বুনা একটি কোমড় বন্ধনী স্বামীকে উপহার দেয়। যে কাপড়টি সে একদিনে সুতা কেটে একদিনের মধ্যে তৈরী করেছে। ধনপদি তার স্বামীকে বলে- এই কোমড় বন্ধনি পড়ে যুদ্ধ করলে তুমি অবশ্যই জয়ী হবে। রণ সম্মুখে শত্র“ পরাজিত হবে। ইতিহাসে জনশ্রুতি আছে রাধামন এই কোমড় বন্ধনী পড়ে যুদ্ধে জয়ী হয়। এখানে ইতিহাসের একটি বিষয় উলেখ্য যে, তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েরা যে পাঁচটি কাপড় পরিধান করেন (পিনন, খাদি, সালুম, মাদা কাবং,পা-দুরি) তার মধ্যে পা-দুরি (কোমড় বন্ধনি) অন্যতম। এই পা-দুরিই হচ্ছে ধনপতির সতীত্ব নির্দশন কোমড় বন্ধনি। এই কোমড় বন্ধনির বিশেষত হচ্ছে পরনের কাপড়কে শক্ত করে আটকে রাখা যেন কোন ভাবে বা কর্মে খুলে না যায়। এই পা-দুরি বা কোমড় বন্ধনী তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েরা যখন কাপড় পরেন বিশেষ করে পিনন পরেন তখন একে  গায়ের বা কোমড়ের সাথে শক্ত ভাবে আটকে রাখার একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যেন কাপড় শরীর থেকে কাপড়টি খসে না পড়ে। যেটি অন্য আদিবাসী মেয়েরা পড়ে না। ধনপদির কোমড় বন্ধনীর সাথে তঞ্চঙ্গ্যা মেয়েদের পরিধেয় বস্ত্র পা-দুরি‘র কোন ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে কিনা। তাছাড়া ব্যক্তি রাধামন-ধনপতির মাঝে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি তাদের ইতিহাসের সুখ স্মৃতি অনুভব করে। যেটি ইতিহাসের পাঠ্য বা গবেষণার বিষয় হতে পারে। 

উপসংহারঃ আদিবাসী সাহিত্যে রাধামন-ধনপতির মতো আরো অনেক পৌরানিক সাহিত্য বা পালা রয়েছে যেগুলি সাহিত্য প্রেমিদের আন্দোলিত করে তুলে। এই উপকরণগুলি ‘সাহিত্য রস’ আস্বাদনে এখনো অবহেলায় অযত্নে পড়ে আছে সবার অগোচরে। এগুলিকে তুলে এনে যত্ন করতে হবে রত্ন পাওয়ার জন্য। তখন আদিবাসী সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যও নতুন মাত্রা বা প্রাণ পাবে। 

তথ্যসূত্রঃ

১.      শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাধামন ধনপদি কাব্য। 

২.      শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, বিজয়গিরি(নাটক)।

Toingang
Toingang
Articles: 55

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *